পিছে চাবুক

Page Visited: 49
118 Views
পিছে চাবুক:
লিখেছেন জনাব কামরুল বারি কামাল।
ফরিদপুর শহরের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য- “ভাড়ার ঘোড়ার গাড়ী” (Horse drawn Public carriage[coach], এক কথায় ঘোড়াগাড়ী। এগুলো ষাটের দশকের প্রথমদিকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।একই ধরনের ভাড়ার ঘোড়াগাড়ী ঢাকাতেও ছিল, কালের আবত্যে হারিয়ে যায়। ঢাকার ভাড়ার ঘোড়াগাড়ীর উল্লেখ এজন্য করছি কারণ ফরিদপুরের পুরনো ঘোড়াগাড়ীর কোন ছবি বা নিদর্শণ আমার কাছে নেই।ঢাকার ঘোড়াগাড়ীর কিছু পুরনো ছবি যুক্ত করলাম যা থেকে ধারণা করা যাবে ফরিদপুরের ঘোড়াগাড়ীগুলো দেখতে কেমন ছিল।আসল ছবিগুলো সাদাকালো, রঙিন ছবিগুলো গুগুল পিক্সেলে সম্পাদন করে ছবির স্বচ্ছতা/স্পষ্টতা বাড়ানো হয়েছে।দৃষ্টিআর্কশণ করছি ঢাকা কার্জন হলের সামনের রঙিন ছবিটি, দেখুন কত সুন্দর ছিল এ ঘোড়াগাড়ী। দেখতে একেবারে রাজকীয় (Majestic), আপনারা কি বলেন?
একটি ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করলাম যা নেয়া হয়েছে “সাতপাকে বাধা” চলচিত্র থেকে। ক্লিপটি পোস্ট করার দুটো কারণ, প্রথমত ভিডিওটি থেকে ঘোড়াগাড়ীর গঠন/গড়ন, তার ব্যবহার ও চালনোর বাস্তব ধারণা পাওয়া যাবে, দ্বিতীয়ত এটি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত – ভিডিওটিতে নায়িকা কলকাতা থেকে ট্রেনে করে ফরিদপুরের মত একটি ছোট শহরের রেলষ্টেশনে নেমে ঘোড়াগাড়ীতে করে তার কর্মস্থলে যায়। আমরা ( বাবা মা, রড়বোন, আমি, ছোটভাই এবং ছোটবোন) ছোটবেলায় বছরে একবার আমাদের ঝিলটুলির বাসা থেকে ঘোড়ার গাড়ীতে করে ফরিদপুর রেলষ্টেশনে নেমে ট্রেনে করে বেড়াতে যেতাম আমাদের গ্রামের বাড়ী সহস্রাইল ও পরে মামাবাড়ী কাশীয়ানি/ভাটিয়াপাড়ায়।ফেরার পথেও ফরিদপুর রেলষ্টেশন থেকে ঘোড়াগাড়ীতে করে ঝিলটুলির বাসায় আসতাম।এ স্মৃতি মধুর এবং অম্লান। যাইহোক ফরিদপুরের ঘোড়াগাড়ীর কথায় আসি, ফরিদপুর রেলষ্টেশনের কাছে ঘোড়াগাড়ীর একটি স্টান্ড ছিল।ঘোড়াগাড়ীগুলো প্রধানত বর্তমান মুজিব সড়কে টেপাখোলা থেকে চকবজার এই রুটে চলাচল করতো।
 
চকবাজার আলীপুর মোড়ে(ফরিদপুর নিঊমার্কেট প্রধান গেটর কাছকাছি)এবং টেপপাখোলায় ঘোড়ার গাড়ীর স্থায়ী স্টান্ড ছিল।ফরিদপুরের অন্য রাস্তায়ও ঘোড়ার গাড়ী চলতো তবে চুক্তিভীত্তিক (গন্তব্য অনুযায়ী দরদামের ভিত্তিতে)।যতদুর আমার মনে আছে গাড়ীর ভেতরে বসার জন্য চামরায় আচ্ছাদিত সোফা সাদৃশ্য দুটো বসার আসন ছিল,মুখোমুখি তিন জন করে ছয়জন বসতে পারতো।গাড়ীর ছাদে ও পাশে ভারী মালামাল বহনের ব্যবস্থা ছিল। ঢাকা কার্জন হলের সামনের রঙিন ছবিটি ঝুম করলে দেখতে পাবেন যাত্রীর মালামাল (লাগেজ) গাড়ীর ছাদে ও পিছে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাধার জন্য পিতলের হুক/আংটা রয়েছে। গাড়ীর পিছের অংশে লোহার ফ্রেমে আটকানো ছোট একটি কাঠের আসন ছিল পেছনের চাকা দুটির মধ্যবর্তি স্থানে।এটি মূলতো ঘোড়ার ঘাস রাখার কাজে ব্যবহার হতো, সাধারণত এই সিট খালিই থাকতো। দুরন্ত ছেলেরা চলন্ত ঘোড়ার গাড়ীর পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে লাফিয়ে গাড়ীর পিছের ছোট সিটে চুপিসারে বসে বিনাভাড়ায় ঘোড়াগাড়ীতে চড়ার আনন্দ উপভোগ করতো।চলন্ত গাড়ীতে পিছের ছিটে বসা চ্যলেজিং ও বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন কাজ ছিল। গাড়ীর গতির সাথে নিজের দৌড়ের গতির সন্মনয় ঘটিয়ে সময়মত নিজের শরীরকে লাফিয়ে শুন্যে তুলে ৩৬০ ডিগ্রী শরীর ঘুরিয়ে পিছনফিরে বসতে হতো। আসনটির অবস্থান ছিল চালকের(কোচোয়ানের) দৃষ্টির বাইরে, এ আসনে কেউ পিছন ফিরে লাফ দিয়ে বসে গেলে চালক তা দেখতে পেত না বা টের পেত না। রাস্তার লোকেরা চিৎকার করে বলতো, “পিছে চাবুক”। “পিছে চাবুক” শোনা মাত্রই কোচোয়ান বুঝে ফেলতো পিছের ছিটে কেউ আছে, তখন সে তার শরু লম্বা চামড়ার তৈরি চাবুক পিছে চালাতো। চাবুকের আঘাত বেশ বেদনাদায়ক ছিল, হুরমুর করে চলন্ত গাড়ী থেকে নামতে গিয়ে হাটুর চামড়া রাস্তার খসায় ছুলে যেত। তবে অনেক ঘাম ঝরিয়ে ঘোড়ার গাড়ীর পিছে চড়ার আনন্দ হাটুর ব্যথা ভুলিয়ে দিত। “পিছে চাবুক” কথাটি তখনকার ফরিদপুর শহরের একটি প্রচলিত বাক্য এবং এ কথাটা মনে হলে এখনও মনের মাঝে নষ্টালজিক অনুভুতি কাজ করে।অনেক সময় গাড়ীর পিছে কেউ না থাকলেও মসকরা(মজা) বা কোচোয়ানকে বিভ্রান্ত করতে বলা হতো, “পিছে চাবুক” আর কোচোয়ানের অহেতুক পিছে চাবুক চালানো দেখে আশেপশের লোকেরা বেশ মজা পেত।
আমার জানা মতে ভাড়ার ঘোড়াগাড়ীগুলোতে ফরিদপুর পৌরসভার নিবন্ধীকৃত গাড়ী হিসাবে লাইসেন্সের নম্বর প্লেট লাগাতে হতো।ঢাকার চকবাজারের ছবিটি ১৯০৪ সনের, তারমানে ঢাকায় এ গাড়ীর প্রচলন অনেক আগে থেকে।ফরিদপুরে কবে থেকে এ গাড়ীর চলা শুরু তা আমার জানা নেই, করো জানা থাকলে জানাবেন। তবে ফরিদপুর পৌরসভার পুরনো নথি থেকে জানা যেতে পারে।
ততকালীন পূর্বপাকিস্তানের সতেরোটা জেলার মধ্যে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলা ছাড়া আর কোন জেলা শহরে ঘোড়াগাড়ীর গনপরিবহন ছিল বলে জানা নেই।রাজশাহীতে টমটম চলতো, টমটম এক ঘোড়ায় টানা ভ্যান সদৃশ্য গনপরিবহন ওটা কোচের (Coach) ক্যটাগরিতে পরে না।ফরিদপুরেও এক ঘোড়ায় টানা গাড়ী ছিল মালামাল নিয়ে চকবজারে আসতো।গাড়ীর মালামাল টানার অংশটা গরুর গাড়ীর মতো কিন্তু সাইজে ছোট।গাড়ীগুলো হাটবারে বেশী দেখা যেত কতোয়ালী থানার মোড়ে , মাল খালাসের পরে ঘোডাকে গাড়ী থেকে বিচ্ছিন্ন করে থানার খোলা মাঠে ছেড়ে দেয়া হত।তখন কতোয়ালী থানায় এত বড় প্রাচীর ছিল না।কাটা তারের নড়বড়ে(নাজুক) নিচু রেড়া ছিল ওর ভেতরদিয়ে যেকেউ ঢুকে যেত পারতো।ঘোড়াগুলো মনের আনন্দে খোলা মাঠে ঘাস খেতে খেতে ঘুরে বেড়াতো।এখানেও ডানপিঠে ছেলেরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোড়া চালিয়ে বেড়াতো।লাগাম ছাড়া খালি হাতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোড়া চালানো মোটোও সহজ কাজ নয়।আমার ছোটবেলার এক বন্ধু লাগামবিহিন ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোড়া চালাতে পারদর্শি ছিল। ওর কাছ থেকে আমি কিছুটা শিখে ছিলাম তবে ওর মতো চালাতে পারতাম না। ঘোড়ায় চড়ে ঘোড়ার গলা ধরে নিজের দুইপা দিয়ে ঘোড়ার পিছে আঘাত করে ঘোড়া চালানোর মজাই আলাদা।
আসল প্রসঙ্গ ভাড়ার ঘোড়ার গাড়ীতে ফিরে যাই——-
সবচাইতে দুঃখজনক হলো এতসুন্দর ঘোড়াগাড়ী সংরক্ষন করা হয়নি, এমনকি ঢাকাতেও না।অন্তত ঢাকা যাদুঘরে আসল(real) ঘোড়াগাড়ী সংরক্ষন করা উচিত ছিল।আমরা ফরিদপুর বাসিরা কি পারিনা হারিয়ে যাওয়া ঘোড়াগাড়ী নুতন করে বানিয়ে সংরক্ষন করতে? আমি আছি, আমার সাথে কে কে আছেন?
চলবে…..

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *