শেকড়ের টানে
এখন আমার বয়স ৮৫, ছোট বোনের উৎসাহে নিজের পুরোনো স্মৃতি লিখলাম। নতুন প্রজন্মের কাছে আমার দেখা এই দেশটি অজানা। এই লেখাটি দিয়ে হয়ত আপনাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারব।
ফরিদপুর অধুনা বাংলা দেশের একটি district
টাউন। আমার ছোট বেলার কিছু টা সময় ওখানে কেটেছে। দাদু- দিদি-মা,তার মা ও মামাদের সাথে আমি ও আমার দাদা ওখানে ছিলাম। মা – বাবা থাকতেন কলকাতায়। মামা বাড়ি ছিল খাবাসপুর অঞ্চলে। ফরিদপুরে জজ কোর্ট ও বিশাল জেলা কারাগার ছিল। দাদু যেহেতু উকিল ছিলেন এবং দুটো এস্টেটের আইনি মামলা দেখতেন, কোর্টে ওনার রোজই যাতায়াত ছিল।
খাবাসপুরের একদিকে পদ্মা ও অন্যদিকে ছিল ব্রক্ষ্মপুত্র নদী। বাড়ি র কাছেই ছিল একটি খাল। বর্ষাকালে বেশ জল থাকতো কিন্তু অন্য সময় হাঁটু জল। সেখানে প্রায় ই শুশুক দেখা যেত। রাস্তা ছিল খোয়া দিয়ে ঢাকা। যানবাহন বলতে দুটো ঘোড়ায় টানা টঙ্গা আর সাইকেল রিক্সা।
কলকাতা শহর থেকে ফরিদপুর ট্রেনে পৌঁছতে হতো। তারপর টঙ্গায় রাজবাড়ী হয়ে খাবাসপুরে যেতে হোতো। ওখানে সব বাড়িতেই corrugated টিনের চাল থাকত। বাঙলাদেশে ভীষনই বৃষ্টি হয়। তাই এই ব্যবস্থা । আবার টিনের চালের নীচে কাঠের পাটাতন থাকতো। সেখানেই আমার দিদিমার সংসারের দরকারি জিনিসপত্র রাখা থাকত। মই দিয়ে ওঠা- নামার ব্যবস্থা। বাড়িতে electricity ছিল। সেটা কম বাড়িতেই ছিল।
মনে পড়ে খালপাড়ে জগৎবন্ধুর আঙ্গিনা ছিল।এটি ছিল বৈষ্ণবদের একটি আখড়া। প্রতি রবিবার শিষ্যরা ভিক্ষা সংগ্রহ করতে আসতেন। গৃহস্থরা নিজেদের সাধ্যমত চাল,ডাল, সবজি ইত্যাদি দিতেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ও ছেলেরা সকলেই স্কুলে পড়াশোনা করত। গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল ( ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত) ও জেলা স্কুল দশ ক্লাস পর্যন্ত ছিল। আমি গার্লস স্কুলে পড়তাম ও দাদা ট্যাপাখোলায় বয়েজ স্কুলে পড়ত। বিশাল জায়গা নিয়ে এই স্কুল বাড়ি গুলো ছিল। তিন মামাও জেলা স্কুলে ই পড়েছেন।
স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়।’ বৃটিশ খেদাও’ এর ঢেউ চারিদিকে। সশস্ত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ফরিদপুরের যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমাদের বড়মামা মাঝে মাঝেই রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পরে বন্ধুদের সাথে কোথাও যেতেন। জিগ্যেস করলে বলতেন মৃতদেহ দাহ করতে শ্মশান ঘাটে যেতে হয়। এইরকমই চলছিল।এই পূণ্যকাজে কেউ বাধা দিত না।
মেজমামার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন পুলিশ কমিশনারের ছেলে। কী করে তিনি জানতে পেরেছিলেন জানি না।একদিন সুলতান মামু বাড়িতে এসে খবর দেন আগামী কাল বাড়িতে পুলিশ সার্চ হবে। কেন? তখন জানা গেল রোজ রাতে মামা স্বদেশী দলের সঙ্গে বোমা বানাতে যান। দাদু দিদিমার মাথায় হাত। সঙ্গে সঙ্গে মামার কলকাতা যাবার ব্যবস্থা করা হল। রাতের অন্ধকারে সেই খাল সাঁতরে স্টেশনে পৌঁছে কলকাতা। সে যাত্রায় প্রাণের তোয়াক্কা না করে প্রাণ রক্ষা হয়।
আমার এবং দাদার মুসলিম বন্ধুদের সাথে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। জাহানারা ও রোশেনারা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। ঈদের দিন আমায় ওদের বাড়িতে নিয়ে মিষ্টি খাবার খাওয়াত। আমাদের বাড়ি তে ওরা যখন আসত, দিদিমাও খুব যত্ন করে ওদের খেতে দিতেন। হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ আমরা জানতাম না।
ফরিদপুরে ইলিশ মাছ খুব পাওয়া যেত। শ্রাবন- ভাদ্র মাসে প্রায়ই দাদু একসাথে ৪/৫টা মাছ নিয়ে আসতেন। সেদিন মাছ ভাজা থেকে শুরু করে মাছের ডিমের অম্বল কিছুই বাদ যেতো না। পুঁটি মাছ খায়নি এরকম লোক ফরিদপুরে পাওয়া যাবেনা। দাদা খালের থেকে ছিপ দিয়ে ছোট মাছ ধরার কায়দা জানত।
পিতৃগৃহ থেকে দিদিমা অনেক সম্পত্তি পেয়েছিলেন কিন্তু সব খুড়তুতো ভাইদের দান করে দিয়েছিলেন।হয়ত সেই পূণ্যতেই মামারা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। যাদের কথা লিখছি তারা কেউ আজ জীবিত নেই। ফরিদপুর নামে ই তারা আবেগ প্রবন হয়ে যেতেন।
দাদার দুষ্টুমি র জন্য পাড়ার লোকেরা খুব ব্যতিব্যস্ত থাকতো। দাদু কে প্রায় নালিশ শুনতে হতো। পাড়ায় তিন উকিলের তিন মেয়ের ঘরের নাতি ছিল সেরা দুষ্টু। লোকেরা বলতেন “বাবুল,বাবলু দুলাল, শয়তান তিন পোলাপান।” দিদিমার মা ছিলেন বড় স্নেহময়ী।পাড়ায় আমার সমবয়সী কোন মেয়ের ছেঁড়া জামা দেখলে, আমার জামা দিয়ে দিতেন।কোন মহিলাকে ছেঁড়া শাড়ী পড়া দেখলে মায়ের বা মামীদের শাড়ি দিয়ে দিতেন।
তিন মামার সুনাম ছিল খেলা ধুলায়। বড়মামা কলকাতায় আশুতোষ কলেজের ফুটবল টিমের Captain ছিলেন। ঘুড়ি ওড়ানো ও গুলি খেলায় পারদর্শী ছিলেন। ছোট মামা দৌড়ে কোনদিন দ্বিতীয় হয়নি। কিন্তু মেজ মামা ক্রিকেট খেলায় উৎসাহী ছিলেন । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওনার বন্ধু প্রীতি অটুট ছিল। আত্মীয় ও বন্ধু দের অকাতরে সাহায্য করেছেন। হাস্য রসের যাদুকর ছিলেন।
কবি জসীম উদ্দিন এই ফরিদপুরে ই ছিলেন।
বিখ্যাত পরিচালক মৃনাল সেন,গায়ক সুধীর লাল চক্রবর্তী মেজ মামার বন্ধু ছিলেন। আমাদের ঢাকুড়িয়ার বাড়িতে সুধীরলাল এসে গান গেয়েছেন। Anderson Club এর Vice President থাকাকালীন মামা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে club পরিচালনা করেছেন।
আর ছোটমামা ছিলেন দাদার থেকে একটু বড়। কিন্তু মামা দুষ্টুমি তে দাদা র সাথে পেরে উঠতেন না। মামা একটা খাতায় পেছনে তারিখ দিয়ে দাদা কবে কী দুষ্টুমি করেছে লিখে রাখতেন। উদ্দেশ্য একটাই, মা যখন ফরিদপুরে আসবেন তখন এগুলো দেখিয়ে দাদা কে উত্তম মধ্যম খাওয়াবে। দাদা এটা জানতো কিন্তু কিছু বুঝতে দিতনা ।একদিন দাদা শুনলো মা পরের দিন ফরিদপুরে আসছেন। রাতের বেলা ছোটমামা ঘুমোলে,ব্যাগ থেকে খাতাটা নিয়ে সব পাতা ছিঁড়ে স্কুলের পথে ফেলে নিশ্চিন্ত। এবার খাতার পাতা ছেঁড়া দেখে মামা আমার কাছে খুব কেঁদেছিল।
ফরিদপুরে র গল্প একবার শুরু হলে আর শেষ হোত না।
মেজ মামা র একবন্ধু ছিলেন মনতোষ নাম। ক্লাসে মাষ্টার মশাই জিগ্যেস করেছিলেন , “মনতোষ,মিছরির ছুড়ি দিয়া বাক্য রচনা কর”। মনতোষের সাথে সাথেই উত্তর। ” বালকটি মিছরির ছুড়ি দিয়া ডাবখানি ফালা ফালা কৈরা কাটিয়া ফেলিল।” আর যায় কোথায়? “! পিঠে পড়ল কয়েক ঘা।
পাগলা রেনু ছিল আর এক বন্ধু।অনেকটাই সুকুমার রায়ের ‘পাগলা দাশুর’মতন। মনতোষ কে ক্ষেপাতেন ” ফুলদল দিয়া কাটিলা কী বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?”এক একটা খুব খাঁটি কথা বলে সবাইকে খুব হাসাতেন। একবার বলেছিলেন ” দেখো বন্ধু রা, মুসলমানদের সাথে আমাগো যত ই ফারাক থাকুক,জুতায় কিন্তু সবাই সোজা।” মানে জুতো পড়ার সময় ডান এবং বাম পা এক ই রকম।
দিদিমার তিনটি গরু ছিল। রবি, রানি আর ধবলী। রবি সারা পাড়া ঘুরে বেড়াত এবং সন্ধ্যা হবার আগেই ফিরে আসত। অনেকেই রবি কে রুটি, সবজি,গুড় খেতে দিতেন। ও নাকি খুব পয়া ছিল।গোয়ালের দেখভালের দায়িত্বে ছিল গোকলা। তখন তো fridge ছিল না তাই সারাদিন বাইরে উনুনে জ্বাল দিয়ে দুধের কড়া পাকের মিষ্টি খাবার দিদি মা বানিয়ে রাখতেন। কেউ জল চাইলে বাড়িতে তৈরী মিষ্টি অবশ্যই দেওয়া হতো। কলকাতায় কেউ গেলেই আত্মীয় স্বজন দের জন্য চন্দ্রপুলী বা প্যাড়া পাঠিয়ে দিতেন।
দুই মামা কলকাতায় চাকরি করতেন। দিদিমা পাড়ার দুই সুন্দরী মেয়েকে আমাদের দুই মামী করে নিয়ে এলেন। এদের স্বামীরা কলকাতায় কর্মসূত্রে থাকতেন কিন্তু দেওর, ভাগ্নে ভাগ্নী,শ্বশুড়, শ্বাশুড়ি নিয়ে কী আনন্দে সুন্দর সংসার করেছেন। এ যুগে ভাবা যায় না।
বাড়িতে আম, সুপুরি, নারকেল, জামরুল, পেয়ারাআর অত্যন্ত মিষ্টি টোপাকুলের গাছ ছিল। অনেক দিন সকালে খেজুরের রস খেয়েছি। বাকি টা একজনকে গাছে হাড়ি টাঙিয়ে রেখে বিকেলে নিয়ে যেতে দেখতাম। আমসত্ত্ব তো সারা বছর চুষতাম। ওগুলো ছিল আমাদের candy.
ছোট মামা যেহেতু দাদা র সাথে দুষ্টুমি তে পেরে উঠতে না তাই আমার সাথে খেলা করতে ভালো বাসতো।
স্কুলে function হবে । মামা নাচে নাম দিয়ে এল। দাদা বলল মেয়েরা নাচে। মামা কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।সুরু হলো উঠোনে rehearsal. ” প্রলয় নাচন নাচলে যখন” ” Dance directors আমার দাদা আর আমার মাসীর ছেলে। আমি দর্শক। সেই দৃশ্যটা মনে করতেই আমার লেখা বন্ধ হয়ে গেল।একা একা অনেকটা হাসলাম।
দাদা পড়তে চাইত না। সাহেব দের মতো ফর্সা গায়ের রং ছিল। ঘরে থাকত কম, রাস্তা য় টোটো। রাস্তা ঘাটে দেখা হলেই মাষ্টার মশাইরা দাদু র কাছে নালিশ করতেন,”এত মেধা ছেলেটার,একটু পড়লেই ভালো ফল করতে পারে।” কে কার কথা শোনে? দাদু র কাছে কানমলা খেয়ে কানটা সবসময় লাল টকটকে।
স্কুলে inspector আসবেন। মাষ্টারমশাই রা speech লিখে দাদাকে পড়তে বলেন। দাদা ছোটমামা কে বলল,”তুই তো এত লেখা পড়া করিস, ভালো ছেলে, তোকে কী ডাকলো? আমাকেই তো ডাকলো।” একদিনে সমস্ত টা মুখস্ত করে ফেললো। অনেক অভিভাবকরা বাড়িতে এসে বলেছিলেন দাদা নাকি ইংরিজিতে খুব ভালো বলেছিল। পরীক্ষা র প্রস্তুতির জন্য একজন গৃহ শিক্ষক রাখা হলো। কিন্তু দাদাকে মারে সাধ্য কার? দিদিমার মা (বুড়ি মা) পেছনে বসে থাকতেন। একবার পাশে র বাড়ির লোক ডেকে এনেছিলেন এই বলে “ছেলে টারে খুন কইরা ফ্যালাইবো, তোমরা বাঁচাও” ।
তখন চারিদিকে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান বিভাজন নিয়ে কথা বার্তা চলছে। শুধু ‘গরম হাওয়া’। ছোটমামা মেদিনীপুরে মাসীর কাছে চলে গেল। দাদু আমাকে ও দাদাকে কলকাতা য় পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন।এক অবশ্যম্ভাবী ডামাডোলের আশঙ্কা সবার মনে। নিজেদের এত দিনের ঘর সংসার পেছনে ফেলে চলে যেতে হবে।
দিদিমা শক্ত মনের হলেও মাঝে মাঝে ই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতেন। যৎসামান্য দামে বাড়ি বিক্রি করে, নিজের হাতে বড় করা গাছ গাছালির মায়া ত্যাগ করে কলকাতা চলে এলেন।
আমি বৃত্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সব বন্ধ করে চলে এলাম। কলকাতা শহরে মন টিঁকছিল না।। কলকাতায় ঢাকুরিয়ায় বাবা বড় বাড়ি বানিয়ে ছিলেন। ঢাকুরিয়ায় বিনোদিনী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী তে ভর্তি হলাম।
হঠাৎ একদিন আমার নামে বাড়িতে একটা পার্সেল। মা খুলে দেখলেন ফরিদপুরের স্কুলের সেলাই দিদিমণি জ্যোতি দি পাঠিয়েছেন। উনি খৃষ্টান ছিলেন।। আমি যে সেলাই গুলো শেষ করে ছিলাম সেগুলো ও তার সাথে যেটা অসম্পূর্ণ ছিল সেটা কী করে শেষ করতে হবে হাতে লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অনেকদিন পরে একবার স্কুল থেকে একটা sports meet এ সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে গিয়েছিলাম। ওমা! সেখানেই আমার সাথে দেখা হোলো সুধা দত্ত ও প্রতিভা ব্যানার্জী নামে দুই ফরিদপুরের দিদিমনির সাথে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কত প্রশ্ন। সুধা দত্ত ছিলেন আমার মায়ের সময়ের Headmistress. আমিও খুব আনন্দ পেয়েছিলাম ওনাদের দেখে।
শুরু হলো আমার শহর জীবন। এতগুলো বছর এই কলকাতা শহরের সাথে জড়িয়ে আছি। ইউরোপ, আমেরিকা, ইঙলন্ড,স্কটল্যান্ড ঘুরে পৃথিবীর বিচিত্র শোভা দেখে এসেছি। আজ ফরিদপুরের কথা বলতে পেরে খুব হাল্কা লাগছে। বাংলাদেশ গিয়েছিলাম কিন্তু ফরিদপুরে যাওয়া হয়নি। দাদা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যাবার আগে ফরিদপুর ঘুরে এসেছিলেন।ওর কাছে এখনকার ফরিদপুরের গল্প শুনেছি।পারিনি মেলাতে ফেলে আসা আমার ছোটবেলার সেই ফরিদপুরকে।
————————————————————————- অনুভা গাঙ্গুলি
সাদার্ণ এভিনিউ
কলকাতা।
Recent Comments