আমার দেখা চকবাজার পর্ব ৩
11/05/2024
Page Visited: 55
155 Views
পুরনো মাছবাজার ও মারোয়ারি পর্টি:
আমার দেখা চকবাজার – পর্ব ৩
লিখেছেন জনাব কামরুল বারি কামাল।
ফরিদপুর চকবাজার কবে থেকে শুরু ? খুবই কঠিন প্রশ্ন। বুয়েটের Department of Urban and Regional Planning- এর একটি Thesis পেপার থেকে জানা যায়, ফরিদপুর চকবাজারের বিস্তার শুরু হয় ১৬৬৬ সনে যখন ফরিদপুর মোঘল শাসনের আওতায় আসে, অর্থাৎ সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমলে। চক একটি হিন্দি শব্দ যার অর্থ রাস্তার মোড়ের উন্মুক্ত বাজার বা হাট। ফরিদপুর চকবাজার হাট দিয়ে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে এটি বাজারে পরিনিত হয়েছে।মোঘল আমলে শুরু এই হিসেবে চকবাজারের বয়স ৩৫০ বছরের উপরে।তবে মোঘল আমলে বাজারের বিস্তৃতি কতদুর ছিল তা বলা মুশকিল।আমি দৃষ্টি আকর্ষন করছি সংযুক্ত গুগল ম্যাপের স্নাপসটে যেখানে চকবাজারের পরিধিসহ পৃথক পৃথক বাজারের অবস্থান দেখানো হয়েছে।আমার মতে গুগল ম্যপে যে জায়গাটুকু চকবাজার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা বাজার বা হাট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে ৩৫০/৪০০ বছর ধরে, প্রথমে আকারে ছোট ছিল আস্তে আস্তে তা বড় আকার ধারন করছে।বাজারটি কেন এই জায়গায় হলো তার একটি ভৌগলিক/ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে যদিও ব্যাখ্যাটি আমার একান্ত নিজেস্ব।বাংলাদেশ পৃথিবির সবচাইতে বড় বদ্বীপ(Delta), ফরিদপুরের উৎপত্তি পদ্মা ও বহ্মপুত্রের বদ্বীপের সৃষ্টি থেকে।এই দুই নদীর বহনকৃত পলি জমে জমে জমি উচু হয়ে ফরিদপুর, বরিশাল ও নোয়াখালির সৃষ্টি।ফরিদপুর শহরের প্রাকৃতিক ভূপৃষ্ঠ বন্যার স্বাভাবিক স্তর( Natural Flood Level) থেকে নীচে, তাই আমাদের ছোটবেলায় (যখন Sluice gate ও বন্যা রক্ষা বাধ ছিল না) বন্যার সময় পুরো শহর পানির নীচে নিমজ্জিত থাকতো তবে চকবাজার ব্যতীত।এটাকি মানুষের তৈরি ? তিন চারশ বছর আগে মানুষ অন্য যায়গা থেকে মাটি কেটে এত বড় যায়গা উচু করবে এর সম্ভবনা খুব কম। প্রাকৃতিকভাবে অন্য যায়গা থেকে বেশী পলি জমেও জায়গাটা উচু হয়ে থাকতে পারে অথবা কোন ভূমিকম্প থেকেও হতে পারে।আটারো শতক ও তার আগের প্রায় প্রতি শতকেই একটা দুইটা বড় ভূমিকম্প হয়েছে এ অঞ্চলে। ভূমিকম্প থেকে চকবাজারের উচু জমির সৃষ্টি হতে পারে।ফরিদপুর জেলার মত জলাভূমি পূর্ন অঞ্চলে নদীর পাশে স্বাভাবিক বন্যার চেয়ে একটি উচু জমি বাজারের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান ।যখন এ অঞ্চলে নৌযানই ছিল একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম তখন ফরিদপুর চকবাজার তার ‘নদীরপাশে উচু জমি’ এই চারিত্রিক বৈশিষ্টের কারণে এই জায়গাটি বড় বানিজ্যিক কেন্দ্রে পরিনিত হয়।এই অঞ্চলের অনান্য হাট/বাজার যেমন নগরকান্দা, সালথা, তালমা, সদরপুর, পুকুরিয়া, ভাংঙ্গা, টেকেরহাট, মাদারীপুর, পালং, মোকসেদপুর, গোপালগন্জ, কানাইপুর, বোয়ালমারী, কামারখালী, নড়াইল, মাগুরার পন্য আদান প্রদান ও কেনা বেচার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই ফরিদপুর চকবাজার।
বাজারের বর্তমান গঠণ থেকে এটা ধারনা করা যায় ম্যাপের পিংক রেখা চিহ্নিত রাস্তাটি প্রাথমিক পর্যায়ে উন্মুক্ত বাজার / হাট অথবা কাচা ঘরে মিশ্রিত উন্মুক্ত বাজার /হাট হিসেবে ব্যবহৃত হতো।কালের আবর্তে চওড়া উন্মুক্ত স্থান (রাস্তা) রেখে দুই পাশে টিনের ঘরের বিভিন্ন ধরনের দোকান গড়ে উঠে। আমরা ছেটবেলায় দেখেছি হাটবারে সবচাইতে বেশী পন্যের সমাগম হতো এই রাস্তাটিতে, এটাই ছিল হাটের প্রান।চকবাজারের স্পর্শকাতর বাজার মাছবাজার।আমাদের সময় আপনি বাজার করতে কতটা পটু তা নির্ভর করে যুক্তিসঙ্গত দামে ভাল মাছ কিনতে আপনি কতটা পারদর্শী তার উপর। তখনকার মাছবাজার অনেক সমৃদ্ধ ছিল মাছের গুনগত মান ও বৈচত্র্যের দৃষ্টিকোন থেকে। তখন ফরিদপুর চকবাজারে কোন বরফ দেওয়া মাছ বিক্রি হতো না, আরো দুটো জিনিষ বিক্রি হতো না এ বাজারে – শুটকি মাছ ও গরুর মাংস।গরুর মাংস বিক্রি হতো না এটা এ প্রজন্মকে বিশ্বাস করানো কঠিন। এটা ধূর্বতারার মত সত্যি।তখন গোটা দেশের অর্থনীতি, কৃষিকাজ, মালপরিবহন ইত্যাদি ভিষনভাবে নির্ভরশীল ছিল গরুর উপর। গেরস্ত কতটা স্বচ্ছল তার পরমাপ ছিল গোয়ালে গরুর সংখ্যার উপর।মেয়ের বিয়ে দিতে আগে খোজ নিত ছেলের বাড়িতে কয়টা গরু আছে? এটা হলো পুরো দেশের অবস্থা এর সাথ ফরিদপুরে মাছের প্রাচুর্যতা ও সহজলভ্যতা যোগ হওয়ায় গরুর মাংস না খাবার সংস্কৃতি গড়ে উঠে।খাসির মাংস বিক্রি হতো মাছবাজারের পূর্ব-দঙ্গিন কোনায়, মাত্র দুজন মাংস বিক্রেতা / কসাই বসতে ওখানে। গরু মাংস বিক্রি হতো ষ্টেশন রোডের এক বিহারির দোকানে তবে সকালে কিনে সারাদিন চূলোর উপর রেখে জ্বাল দেবার পরও সন্দেহ থাকতো মাংস সেদ্ধ হওয়া নিয়ে।বৃদ্ধ গরু জবাই হতো যা হাল চাষে যোগ্য নয় বা যে গাই আর দুধ দেয় না। কোরবানির সময় ছাড়া ভালো গরুর মাংস খাওয়া হতো না।তবে গরুর চেয়ে খাসি বেশী কোরবানি হতো। সাধারনত সাতজনে মিলে ভাগে একটা গরু কোরবানি দিত।স্বাভাবিকভাবে রেষ্টুরেন্টে গরুর মাংস রান্না হতো না।গরু মাংস বানিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু হয় শরিয়াতুল্লাহ বাজার চালু হবার পর।মাছ বাজারে ফিরে আসি, বাজারের প্রধান মাছ ইলিশ।ফরিদপুরের তখনকার ইলিশ বেঁচার পদ্ধতিটা একেবারে বিরল অন্য জায়গা তুলনায়।জেলে রাতে ধরা প্দ্মার ইলিশ বাঁশের ছাপি/ঝুড়ি করে সকালে বাজারে নিয়ে আসতো বিক্রির উদ্দেশ্যে।ইলিশ দিয়ে ঝুড়িটা সাজাতো এত সুন্দর করে তা আমি কিভাবে বোঝাবো? দুই থেকে আড়াই ফুট ব্যসের ঝুড়ির ভেতর কলাগাছের খোলস/ ফ্যতরার তৈরি একটা বড় ডোনাট (Donut) বসানো থাকতো। ডোনাটের উপর এক একটা ইলিশকে বক্রাকারে(curved) একটার গায়ের সাথে একটা লাগিয়ে বৃত্তকারে সাজানো থাকতো। এই মাছের ডালা সাজানোটা এতটাই সুন্দর তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।এইভাবে মাছ সাজবার পিছনে একটি ব্যবসায়িক কারণ আছে।তাজা ভালো ইলিশ চেনার তখনকার প্রচলিত সূচক – ১। ভালো মাছে ধরা পরার পর বাকা (Curved) আকার ধারন করে। ২। ডিমবিহিন মাছ খেতে ভালো ৩। তাজা ভালো মাছের কানের ফুলকি রক্তের মত লাল । এক নম্বর সূচকের কারণেই মাছ কলাগাছের খোসার ডোনাটের উপর বাকা করে সাজানো হতো যাতে মাছ সমতল ভূমিতে রাখার পরও বাকা অবস্থায় থাকে।কারণ যাই হোক মাছের ডালি সাজাবার নান্দনিক সৃজনশীলতাকে স্বীকৃতি দিতেই হবে, কথায় বলে ‘প্রথমে দর্শণধারী পরে গুনবিচারী’ । এখনও বাজারে বরফছাড়া তাজা ইলিশ এভাবে ডালি সাজিয়ে আনা হয় কিনা জানিনা? তখনকার মাছ বাজারের সাইজ ৪০ফুট x ৫০ ফুট, টিনের ছাউনি, সান বাধানো মেঝে চারদিকে খোলা। বিক্রেতারা মাছ নিয়ে বসতো ছয় ইঞ্চি উচু সানবাধানো ব্লকে ভাগকরা মেঝেতে আর ক্রেতারা ব্যরহার করতো ব্লকের মাঝে নীচুতে তিনফুটের মতো চওড়া পায়েচলা পথ। সকালের মাছের বাজারে বেশ ভিড় হতো ক্রেতার ভির ঠেলে মাছ ওয়ালা পর্যন্ত পৌছানো কষ্টসাধ্য ব্যাপার।প্রায়ই ঘটতো, অনেক ছোট বেলায় মাছ বাজারে এক হাত দিয়ে ধরে আছি বাবার কানি/কেনি আঙ্গুল আরেক হাতে থাকা খালুই (ছিদ্রযুক্ত বাঁশের হাতলওয়ালা মাছ বহনের ঝুড়ি) ফেসে গেছে পিছের দুই লোকের মাঝে, সামনে পিছে কোথাও যেতে পারছি না।মাছের প্রাকার ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ব্লকে মাছ বিক্রি হতো।ইলিশ,পাংগাশ,রুই কাতলসহ বড় মাছ বিক্রি হতো পশ্চিম পাশে দালালের মাধ্যমে।ইলিশ বিপনন- জেলে (মাছের স্বত্বাধিকারী) মাছভর্তি ঝুড়িটা দালালের(জেলের মাছ বিক্রির প্রতিনিধি) কাছে সপে দিয়ে চুপটি করে পিছে বসে থাকবে।ক্রেতা ও প্রতিনিধির সংলাপের মধ্যে জেলে কখনই হস্তক্ষেপ করত না।মাছ বিক্রির টাকা ক্রেতার কাছ থেকে নিয়ে প্রতিনিধি জেলেকে দিত, সে টাকাটা তার মাজায় গোজা থলেতে রেখে দিত। ক্রেতা ঝুড়িতে রাখা পছন্দমত একটা মাছ দেখিয়ে বলতো , “এই মাছটা দেখান”। প্রতিনিধি মাছটা তুলে কান উচু করে ফুলকি দেখাবে তারপর নীচে রেখে দেখাবে মাছ কতটা বাকানো আকার ধারন করে আছে। ফুলকির রং পছন্দ না হলে অন্য তাজা মাছ দেখাতে বলতো ( মাছটা কত আগে ধরা পরেছে তার উপর নির্ভর করে ফুলকি কতটা লাল, মাছ ধরা পরা থেকেই প্রাকৃতিক নিয়মে পচনক্রিয়া শুরু হয়ে যায়, যত সময় পার হবে ফুলকির রং লাল থেকে ফ্যকাসে হতে থাকবে।ফুলকি ফ্যকাসে হয়ে যাওয়া মানে মাছ নষ্ট হয়ে গেছে খাবার যোগ্য নয়। এখন ফুলকি দেখে মাছ যাচাই করা কঠিন ফরমালিন দিয়ে মাছের পচন দীর্ঘায়িত করা হয় ফরমালিনতো বিষ আবার রক্ত মাখিয়ে ফুলকি লাল করা হয় , কোন রকম ফরমালিন না ব্যবহার করে শুধু বরফে সংরক্ষিত মাছ তুলনামূলকভাবে ভালো তবে আমাদের সময়কার বরফবিহিন সতেজ মাছের স্বাদ অতুলনিয়)। ক্রেতা মাছ দেখে কখনও বলতো “নাহ মাছে ডিম আছে?” দালাল তখন দুই আঙ্গুল দিয়ে মাছের পেট চেপে ধরে সামনে থেকে লেজের কাছে প্রাকৃতিক ছিদ্র পর্যন্ত নিয়ে সাদা দুধের মত একটা পদার্থ বের করে বলতো, “দেহেন ডিম নাই”।এটা দালালের হাতের কারসাজি/কেরামতি। “দেহেন ডিম নাই” এমন মাছ কাটার পর দেখা গেছে ডিম ঠিকই আছে। মাছের পেটের আকার দেখে আন্দাজ করে নিতে হবে ডিম কি সাইজের তবে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। ছোট ডিমওয়ালা ইলিশ ডিমছাড়া মাছের সমতুল্য ।ডিমছাড়া ইলিশ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার, পুরুষ ইলিশের ডিম নেই কিন্তু ধরা পরে কম।মোটামুটি সাইজের পুরুষ ইলিশ স্বাদে সেরা। একজন ক্রেতা যখন দামাদামিতে ব্যস্ত তখন কিছু ক্রেতা তা পরখ করতো আজকে কত দামে মাছ বিক্রি হচ্ছে তা জানার জন্য। মাছের দর উঠানামা করতো স্বাভাবিকভাবে চাহিদা ও সরবরাহের উপর। কোন কোন সিজনে এত বেশী মাছ ধরা পরতো পচুর ইলিশ অবিক্রিত থেকে যেত। অবিক্রিত মাছ যাতে নদীতে না ফেলা হয় এর জন্য পৌরসভা মাকিং করে সতর্ক করে দিত এবং নিদৃষ্ট জায়গায় মাটি খুরে গর্তে মাটি চাপা দিয়ে দিত।পরিবেশ রক্ষার মানসিকতায় তখনকার সমাজ এখনকার থেকে এগিয়ে ছিল।তখন মানুষ র্নিদ্বিধায় নদীর পানি পান করতো।তাইতো প্রবাদ ছিল ‘জাতের মেয়ে কালোও ভালো আর নদীর জল ঘোলাও ভালো’। এই প্রবাদ ও নদীর জল দুটোরই মৃত্যু হয়েছে।যাইহোক ইলিশ বেচাকেনায় চলে যাই। দরদামের সন্তোষজনক সমাপ্তির পর দালাল কলা গাছের খোলস/ফ্যতরার রশি (আধা ইঞ্চি X আধা ইঞ্চি) দিয়ে মাছটা বেধে (ফ্যতরার রশি কানসার/কানের ভেতর দিয়ে নিয়ে মাছের মুখ দিয়ে বের করে রশির দুই প্রান্ত গিরা দিয়ে হাত দিয়ে বহন করার উপযোগী একটা লুপ তৈরি করে দিত) ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দিত। ইলিশ লোকেরা সাধারনত খালুইতে নিত না হাতে ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে যেত, মজাটা শুরু হতো এখান থেকে, মাছবাজার থেকে বের হয়ে গন্তব্যে পৌছানোর আগ পর্যন্ত পরিচিত অপরিচিত যার সাথেই দেখা হবে সেই জিজ্ঞেস করবে “মাছটা কত নিলো”, উত্তর “একটাকা দুইআনা”, বিভিন্ন পতিউত্তর, “ও আচ্ছা, ভালো কিনেছেন, দামটা একটু বেশী হয়ে গেছে” ইত্যাদ্দি।এর উপর একটা গল্প ছিল, গল্পটা কতটা সত্যি তা জানিনা তবে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল।গল্পটা হলো গোয়ালচামটের একলোক মাছবাজার থেকে একটা সুন্দর ইলিশ কিনে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে একজন জিজ্ঞেস করলো,”ভাই দাম কত নিলো” জবাবে বললো,”পাচসিকা (একটাকা চার আনা)”, আবার আর একজন জানতে চাইলো একই উত্তর “পাচসিকা” ময়রা পর্টি পার হতেই বিশজনকে বলা হয়ে গেছে।সে আলীমুজ্জামান ব্রিজ পার হবার সময় আরো কয়েকজন দাম জানতে চেয়েছে, ব্রিজের মাঝামাঝি যখন এসেছে আর একজন মাছের দাম জানতে চাইলো এর মধ্যে পাচসিকা বলতে বলতে হাপিয়ে গেছে তখন সে বিরক্ত হয়ে “বালসিকা” বলে মাছ ছুড়ে নদীতে ফেলে দেয়।এটা হয়তোবা একটা বানানো গল্প তবে ইলিশ কিনে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবেন আর দাম জানতে চাইলে সাচ্ছন্দে দামটা জানাবেন এটা তখনকার লৌকিকতা এটা আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না।ইলিশ,পদ্মা ও ফরিপুরের মধ্যে একটা যোগসাজস আছে তাই ইলিশের উপর বেশী লেখা হয়ে গেল।পদ্মার আর কিছু ছোট বড় ভালো মাছ বাজারে আসতো।পাংগাস(বিশাল আকারের), আইড়,রুই, রিঠা,বাচা,ঘাওড়া, এর মধ্যে রিঠা সবচাইতে দামী ও সুস্বাদু তবে ধরা পরতো কম তাই বাজার আমদনিও ছিল কম।অনেক ধরনের বিলের ও নদীর মাছ আসতো দুর দুরান্ত থেকে।ভালো কই মাছ পাওয়া যেত বিক্রি হতো বাইসা(এক বাইসা মানে বাইসটা মাছ) হিসাবে, প্রচলিত জিজ্ঞাসা “মাছের বাইসা কত?”।এই বাইসার হিসাবের ব্যখ্যা বা ইতিহাস জানা নেই।কোন মাছই ওজন দিয়ে বিক্রি হতো না।বড় মাছ পিস হিসাবে, বেশী বড় মাছ কেটে ভাগে বিক্রি হতো অনেক সময় কয়েকজনে মিলে মাছ কিনে কাটিয়ে ভাগ করে নিত।অনান্য মাছ ভাগে/থোক হিসাবে বিক্রি হতো।শিং মাগুর নিজের পছন্দ ও সংখ্যা অনুযায়ী থালায় উঠিয়ে দর দাম করে কিনতে হতো।তখনকার দুটি সস্তা মাছ চিংড়ি ও বাইলা/বেলে এখন দামী মাছ।চিংড়িকে মাছের দলে ফেলা হতনা, বলা হতো পানির পোকা তাই দাম কম ছিল।খুবই ছোট কুচা চিংড়ি ভাগে বিক্রি হতো দুই ভাগ কিনলে একভাগ ফাউ।বাইলা মাছের রক্ত নাই তাই এ মাছের কোন উপকারিতা নেই, এই ধারনার কারণে বিক্রি কম দামও কম।’বাচা’ মাছের তুলনা নেই তবে দ্রুত পচনশীল হওয়ায় সতেজ মাছ পাওয়া মুশকিল,বেছে বেছে কিনতে হয়।বাচা জাতের আর একটি মাছ সাইজে বড় খেতে ভালো নাম ঘাওরা,দুর্নাম গু খায় তাই লোকে কিনতে চায় না। এ মাছও দ্রুত পঁচনশীল তাই বরফ/ ফ্রিজে রাখা মাছও বেশীদিন সতেজ রাখা যায় না। দুটো মাছ, চাষের মাছ (Farm fish) আসার আগ থেকেই আস্তে আস্তে ফরিদপুর থেকে হারিয়ে যেতে থাকে।একটি ‘সরপুটি’ আরেকটি টাটকেনি, আগের সরপুটি সরের রংয়ের তাই নাম সরপুটি এবং এখনকার তথাকথিত সিলভার রংয়ের সরপুটি থেকে ছোট কিন্তু খেতে অতুলনীয়।একভাগে চারটা করে চার ভাগ পুঁটি একটা থালায় সাজানো হতো বিক্রির জন্য। ঐ সরপুটি সত্যিই মিস করি। ফরিদপুরে যে টাটকেনি পাওয়া যেত তা ঢাকার এখনকার টাটকেনি থেকে ছোট, মাছের মাংসে ছোট ছোট পাতলা কাটা থাকতো যা গলায় বিধতো না কিন্ত ভাজা মাছে আলাদা মচমচে স্বাদ যোগ করতো।মৎস্য মন্ত্রনালয় উদ্যোগ নিয়েছে হারানো দেশী মাছ পূনউদ্ধার করার, দেশী হারানো মাছ আবার ফিরে আসুক এই প্রত্যাশা নিয়ে মাছের ছাপি বন্ধ করছি।
গুগল ম্যাপের হলুদ রংয়ের চিহ্নিত রেখার রাস্তাটি স্থায়ী স্থাপনার সমন্বয়ে একান্তই বাজার হিসেবে গড়ে উঠেছে।রাস্তার পূবের অংশটি কাপড়ের বাজার আর পশ্চিমের যে অংশটি মারোয়ারির দখলে ছিল তা মনোহারি,হোসিয়ারি ও কাপড়ের দোকান মিলিয়ে সৃষ্টি। ‘রাণী ষ্টোর’ নামে মারোয়ারির একটি চালু দোকান ছিল আমরা বাজি, ঘুড়ির সুতো, মাঠ বা বাড়ি সাজাবার রঙ্গিন কাগজ, খেলনা, পছন্দের ছোটখাটো জিনিষ এখান থেকেই কিনতাম।রাণী ষ্টোরের উল্টোদিকে মারোয়ারিদের দুটি দোকান ছিল যার প্রধান ব্যবসা বাজি বিক্রী।অতি বিস্ফোরক বাজিসহ অনেক ধরনে বাজি পাওয়া যেত এই দোকন দুটিতে।পূজো,বিয়ে, ঈদ, অন্যান্য সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় উৎসবে বাজি ফুটাবার প্রচলন ছিল।কিছু বাজি ছিল অতি বিস্ফোরক, আমাদের প্রিয় বাজি ছিল ʼরকেটʼ বাজি, বাশের চটার আগায় রকেট আকৃতির বাজি লাগানো থাকতো এবং রকেটের নীচের দিকের সলতাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হতো – রকেটের মতো পিছে আগুন প্রজ্বলিত করে উপরের দিকে উঠে যেত বেশ কিছুদুর (চল্লিশ/পঞ্চাশ ফুট) উঠার পর বারুদ শেষ হয়ে গেলে আগুন নিভে নিশ্বেষ হয়ে যেত।আর একটি বাজি ছিল অপূর্ব সুন্দর বাজি(নাম মনে নেই)- ছোট পাতিল আকৃতির মাটির পাত্রের ভিতর বারুদ আর পাত্রের মূখে সলতা লাগানো থাকতো আগুন জ্বালাবার জন্য, পাত্রটি মাটিতে রেখে সলতাতে আগুন দেবার পর বাজিটি চারদিক আলোকিত করে তিন চার ফুট উচু হয়ে হিস হিস শব্দে আগুনের ফুলকির ফোয়ারা তৈরি করতো, ত্রিশ থেকে চল্লিশ সেকেন্ট স্থায়ী থাকতো।ফুলঝরি আতশবাজি, বিভিন্ন ধরনের ও সাইজের পটকা, তারাবাজিসহ অনেক বৈচিত্র্যের বাজি পাওয়া যেত।তারাবাজি নিরাপদ বাজির ভিতর সবচাইতে ভালো বাজি দামেও সস্তা, আগরবাতির মতো দেখতে, নীচের অংশ হাতে ধরে উপরের অংশে আগুন দিলে তারার মত দেখতে একটার পর একটা আগুনের ফুলকি বিচ্ছুরিত হতো আর আমারা হাত ঘোরাতে থাকতাম যাতে তারাগুলো একটা চক্রের আকারে নীচে পরে।তারাবাজির ফুলকিতে চামড়া দগ্ধ হতো না এবং জামাকাপড়েও আগুন ধরতো না।বাজি ফুটাবার মজা বেশীদিন উপভোগ করতে পারিনি, ১৯৬৫ সনে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার সিমিত করে দেয়ার ফলে ভালো বাজি বানানো বন্ধ হয়ে যায়।
গুগল ম্যাপে ‘মারয়ারি পার্ট/কলোনি’ চিহ্নিত জায়গাটিতে মারোয়ারিরা আনুমানিক দুশ বছর ধরে ব্যবসা ও বসবাস করে আসছে। ফরিদপুর চকবাজারের মারোয়ারিদের নিয়ে লেখা ইতিহাস বা প্রবন্ধ কোথাও আমি পাইনি।বাংলাদেশে মারোয়ারিদের আগমন মোঘল আমলে তবে বড় ধরনের আগমন ঘটে ইংরেজ শাষনের আমলে।এরা আঠারো শতকের প্রথম দিকে সুদুর রাজস্থান থেকে ফরিদপুরে আসে ব্যবসা করার জন্য। এরা যে দুশ বঁছর আগে ব্যবসার জন্য এখানে আসে তা মারোয়ারিদের মুখেই আমরা শুনেছি।এদেশে ওদের ব্যবসা গুলো হলো- টাকা ধার দেয়া, হুন্ডি, টাকা বিনিয়োগ, ব্যাংক ব্যবসা, কাপড় ও পাটের ব্যবসা,আড়তদারি ও দোকানদারি ইত্যাদি।নীলের (Indigo) কারবার ও পাটের ব্যবসায় বিনয়োগই মারোয়ারিদের ফরিদপুরে আগমনের প্রধান কারণ বলে আমার ধারনা।এরা জাত ব্যবসায়ি তাই ফরিদপুর চকবাজারের বিভিন্ন ব্যবসার সাথে নিজেদের সম্পৃত করে বাজারের ভিতর এদের নিজস্ব পর্টি/কলোনি গড়ে তুলে, ।এই কলোনির বাইরে কিছু অতি ধণী মাড়োয়ারি বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতো ঝিলটুলীতেই একজন থাকতো নামটা ভুলেগেছি, অম্বিকাপুরে একজন থাকতো এরও নামটা মনে নেই।বাজারে পুরাতন মাছ বাজারের দঙ্গিনে এক ধণী মাড়োয়ারি থাকতো সম্ভবত ১৯৭৫ সনের দিকে ভারতে চলে যায়।
মাড়োয়ারিরা হিন্দু বা জৈন ধর্মাবলম্বী, গনেশ ও লক্ষ্মীর পূজারি।এদের জীবনধারা বঙ্গালী হিন্দুদের থেকে আলাদা। এরা একশোভাগ নিরামিষ ভোজি, ঘিয়ের রান্না খুব পচ্ছন্দ।Community living অর্থাৎ সম্প্রদায় হিসেবে বসবাস করাকে প্রাধান্য দেয়, বয়োজেষ্ঠদের নিয়ে গঠিত পঞ্চায়েতের অনুশাষণ মেনে চলে।নিজেদের সম্প্রদায়ের কেউ আর্থিক অনটনে উপনিত হলে সম্প্রদায়ের তরফ থেকে তাকে সাহায্য করা হয়।চরম পুরুষ শাষিত সমাজ, মেয়েদের কোন নিজস্ব অধিকার নেই, সংসার বচ্চাকাচ্চা সামলানোই প্রধান কাজ, লেখাপড়া করতে পারবে না, বাইরে যেতে পারবে না সর্বক্ষনিকভাবে লোকচক্ষূর অন্তরালে থাকতে হবে।লোকচক্ষূর অন্তরালে থাকার সীমাটা কতদুর তার একটি উদাহরন দেই।চকবাজারের পেটের ভিতর বিশাল জায়গা নিয়ে মাড়োয়ারিরা পরিবার পরিজনসহ দুশ বছর যাবত বসবাস করে আসছে, কিন্তু এমন একটি লোককে আপনি খুজে পাবেন না যে একঝলকের জন্যও মারোয়ারি মহিলা/মেয়েকে দেখেছে বলো দাবী করতে পারবে ! মহিলাদের পর্দার অন্তরালে থাকার এত বড় অনুশাষন আর কোন জাতি/গোষ্টির মধ্যে আছে বলে জানা নেই।বছরে অন্তত একবার মহিলারা ঘরের বাইরে আসতো দূর্গাপূজার অষ্টমি বা নবমিতে দলবেধে প্রতিমা দেখতে তবে যতবড় ঘোমটা দিয়ে থাকতো মুখ দেখার উপাায় নেই।যখন কলেজে পড়ি আমরা কয়েকজন মিলে পুজোর সময় মারোয়ারি মহিলার মুখ দেখবো বলে চেষ্টা চালাই, মিশনটা পুরোপুরি ব্যর্থ, এতবড় ঘোমটা ভেদ করে মুখ দেখা অসম্ভব।এদের বিয়ের অনুষ্ঠান বেশ বড় ও জাকজমকপূর্ণ,অনষ্ঠিত হতো ঘেরাও (Enclosed) জায়গায়। ছোটবেলায় বেশ কয়েকটা বিয়ে দেখেছি, সাধারনত হিতৈষী স্কুলের মাঠে বিয়ের অনুষ্ঠানটা হতো। স্কুলের মাঠ ও স্কুল ঘর চার পাচ দিনের জন্য ভাড়া নিয়ে টিন দিয়ে পুরোটা ঘিরে ফেলতো যাতে বাইরের কেউ ঢুকতে না পারে।ঘেরা জায়গাতেই চার পাচ দিন ধরে আনন্দঘন পরিবেশ বিয়ে সম্পন্য হতো।অনুষ্ঠানের শেষের কোন দিনে বর সুসজ্জিত হাতি বা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ব্যান্ড পার্টিসহ ব্যান্ডের ছন্দে শহর প্রদক্ষিন করতো, এটা বেশ উপভোগ্য ছিল।ʼমারোয়ারি পর্টি ʼএখনো আছে কি নেই এ বিষয়ে আমার ধারনা নেই।শুনেছি বেশীর ভাগই ভারতে চলে গেছে।পারটিশনের পর এ দেশ থেকে মাড়োয়ারিরা চলে যাওয়া শুরু হয়। ছোটবলায় মাড়োয়ারিদের অন্তত ১৯৬৫ সনের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত যা দেখিছি তাতে ওদের মধ্যে ভীতি বা অসন্তোষ লক্ষ্য করিনি, যুদ্ধের পরে কিছু মারোয়ারি এখান থেকে চলে গেছে তবে সংখায় খুবই নগন্য।শুনেছি ১৯৭৫ সনের পর থেকে মারোয়ারিদের চলে যাবার সংখা বেড়ে যায়।মারোয়ারিরা ফরিদপুরের ইতিহাসের একটি অংশ, তাই মারোয়ারিদের উপর গবেষণা মূলক অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য যোগার করে এদের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করা উচিত।
Recent Comments