চৌধুরী আবুল কালাম লিমন ও ফরিদপুরে রক,হার্ডরক মিউজিক রেভ্যুলেশন
17/10/2020
পর্ব-১
বিস্ময়
১৯৯৪/৯৫ সালের শীতের সন্ধ্যা। বড় ভাইয়ের হাত ধরে নাম না জানা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। এককোনে একটা মঞ্চ; মঞ্চে কয়েকজন তরুণ, অগোছালো লম্বা চুল, কাঁধে গিটার। শুকনো শরীরের এক তরুণ ইংরেজি গান গাইছে। গানের একটা অক্ষরও বুঝতে পারছি না। কিভাবে বুঝবো? আমিতো তখন “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে” ছড়া কাটি। ওদিকে বড় ভাই মাঠে দাঁড়িয়ে তার গানে কন্ঠ মিলায়। আর শিশু আমি ঘোর লাগা চোখে এইসব দেখি।
আকাশ কাঁপিয়ে গান বাজছে। মাঠের কিশোর, তরুণ, যুবকেরা মত্ত। “ফিলিংস” এর গানের মত দিন রাত এখানে থমকে গেছে।
গান থামে। বড় ভাইয়ের সাথে বাসায় ফিরে আসি। মনের মধ্যে বিষ্ময়। কারা এরা!!!
পর্ব-২
জিলা স্কুলের পেছনের মাঠে একদল দেবদূত
আশুতোষ স্যারের অংকের ক্লাসে সবাই খুব তটস্থ থাকে। স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস আমাদের কখনোই হয়নাই। ব্ল্যাক বোর্ডে সাদা চক একের পর এক বীজগণিতের সূত্র লেখে। তারই ফাঁকে জানালা দিয়ে দেখি স্কাউট ভবনের পাশে একদল ছেলে বসে আছে। একজনের গায়ে আবার জিলা স্কুলের ড্রেস। কি ভয়ঙ্কর! ক্লাস ফাঁকি দিয়ে স্কাউট ভবনের পাশে বসে আছে!
দূর থেকে ভেসে আসে গান। সেই গান, সেই সুর আশুতোষ স্যারের অংকের সব সূত্র ভেঙে দেয়। চকের গুড়োর সাথে ঝরে পড়ে এর যাবতীয় মারপ্যাঁচ।
সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে জানতে পারি স্কাউট ভবনের পাশে বসে থাকা একজন লিমন (দূর্দান্ত গিটার বাজায়), স্কুল ড্রেস পরে থাকা ছেলেটার নাম আলামিন (ড্রামসের জাদুকর), আরেকজন সাগর (গায়ক, কিবোর্ডিষ্ট), অন্য ছেলেটা সৈকত (বেস গিটার বাজায়)। রক গান গায়। তারা এই শহরের দেবদূত।
পর্ব-৩
রেললাইনের ধারে পড়ে থাকা অলস সময়েরা
ফরিদপুর শহরের রেল চলাচল তখন বন্ধ। অসহায় ষ্টেশনে বিকেলের রোদ এসে শুয়ে থাকে। ব্যাপ্টিষ্ট চার্চ মিশন স্কুলের গ্রেভইয়ার্ডের পিছনেই রেললাইন। পাশেই একটা বিশাল কাভার্ড। তার উপর গিটার হাতে বসে আছে লিমন আর এলিন। লিমন বয়েসে এলিনের চেয়ে বড়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া ঢাকার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে লিমনের যৎসামান্য শিক্ষা, বই থেকে কিছু সাহায্য আর নিজের চেষ্টা ও একাগ্রতা লিমনের গিটার মোহময় সুরে বাজে, বিকেল সন্ধ্যায় গড়ায়। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে খয়েরী আলোয় লিমনেরর দরাজ গলায় এল.আর.বি এর “সেই তুমি” সন্ধ্যার নিরবতা ভেঙে দেয়।
গিটারে লিমনের হাত খেলা করে। ছয়টা তার জীবন খুঁজে পায়।
আঁধার খানিকটা গাঢ় হয়ে এলে লিমন আর এলিন বাড়ি ফেরে। পেছনে পড়ে থাকে ঝড়া সময়ের গান।
পর্ব-৪
অলৌকিক ইষ্টিমার
রেললাইনের ধারে পড়ে থাকা অলস সময়ের হাত ধরে জন্ম নেয় একটা “ব্যান্ড”। “ব্লু স্কাই” নামে সেই ব্যান্ড শহরের কবি জসীমউদ্দীন হলের অডিটরিয়ামে পারফর্ম করে। গিটার ও ভোকালে লিমন, রিদম গিটারে এলিন, ড্রামসে আলামিন, বেস গিটারে সৈকত, কিবোর্ডে সাগর। অচেনা সেই ছেলেদের গান ফরিদপুরের তরুণরা প্রাণভরে উপভোগ করে।
কনসার্ট শেষে অনেকেই ব্যান্ডের দারুণ প্রশংসা করে। বাসায় ফেরার পথে লিমনের মনে হতে থাকে এভাবে নয় অন্যভাবে অন্যকিছু। লিমন এলিনকে ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করার ব্যাপারে ভাবতে বলে।
লক্ষীপুরের দুই কামরার ভাড়া বাসা। এলিন তার ইন্ডিয়ান গিভসন জাম্বো গিটারে টুং টাং করছে। আলামিন স্বভাবসুলভ উম্মাদনায় জেমসের গান গেয়ে চলছে। সৈকত আর সাগর ডিকশনারিতে চোখ গুঁজে রেখেছে। ঠিক তখন লিমন ব্যান্ডের নতুন নাম প্রস্তাব করে। “ক্লেয়ারভয়েন্স”। মানে কি! সবার মনে একই প্রশ্ন। “অলোক দৃষ্টি”, আমরা আমাদের দু’চোখের বাইরে অন্য চোখে এই পৃথিবী দেখবো, প্রতিবাদ আর প্রেরণার গান গাইবো। লিমন ব্যাখ্যা দেয় সব। লিমনের কথার মুগ্ধতায় সবাই ডুবে যায়। জেগে ওঠে ফরিদপুরের প্রথম রক ও হার্ডরক ধারার ব্যান্ড “ক্লেয়ারভয়েন্স”।
পর্ব-৫
বেনসন এন্ড হেজেস ষ্টার সার্চ-২০০২
ছোট আকারে ক্লেয়ারভয়েন্সের কনসার্ট হতে থাকে। শহরের রক গান প্রিয় মানুষেরা তাদের চিনতে শুরু করছে। এর মধ্যে ব্যান্ডে বেসিষ্ট হিসেবে যোগ দেয় লিমনের “হেজ স্প্যারো” গিটার স্কুলের ছাত্র পলাশ, আইয়ুব বাচ্চু পাঁড় ভক্ত। পলাশ আসাতে “ক্লেয়ারভয়েন্স” আরো বেগবান হয়।
কিন্তু ভাবনা অন্য জায়গায়। কাভার গান গাইতে গাইতে লিমন আদতে নিজের গান বানানোর চেষ্টা করছে। “রাতের আঁধার” নামে একটা গানের অর্ধেক শেষ করে বসে আছে অথচ কথা খুঁজে পাচ্ছে না। এগিয়ে আসে পলাশ, গানের শেষ পার্টের কথা লেখে। আর সুর তো লিমনের মাথায় ঘুরছিলো অনেকদিন ধরেই। ব্যান্ডের প্র্যাকটিসে গানটা শুনে নির্বাক হয়ে যায় সবাই। বিশেষকরে লিমনের গিটার সলো আর ইন্ট্রো প্লাকিং। সবার চেষ্টায় তৈরী হয় ফরিদপুরের ব্যান্ডের প্রথম রক ঘরনার গান “রাতের আঁধার”।
“মোস্তাফিজ বিপ্লব” একজন সংগীত প্রেমী, গিটারিষ্ট, গীতিকবি। কবিতার প্রতি অপার ভালোবাসা। গিটারের খুঁটিনাটি অনেককিছুই লিমনের কাছে শেখা। একদিন একটা গান লিখে নিয়ে আসে লিমনের কাছে। এক বসায় সুর হয়ে যায়। ব্যান্ডের কম্পোজিশনে সেই সুর পায় পুর্ণাঙ্গ রূপ। “ঠিকানা নেই আমার, নেই কোন বাড়িঘর” এমন শক্তিশালী কথার গানে ক্লেয়ারভয়েন্সের ঝুলি ভরে।
এরকম দুরন্ত সময়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আসে বেনসন এন্ড হেজেস ষ্টার সার্চ-২০০২ এর। গানের ডেমো রেকর্ড জমা দিতে হবে, সেই গান শুনবেন বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী আর গান মনোনিত হলে আবেদনকৃত জোন অনুযায়ী লাইভ অডিশন। এখানেই শেষ না, লাইভ অডিশনে দুজন বিচারক থাকবেন, সেখান থেকে সিলেক্টেড ব্যান্ডদের ভিডিও ঢাকার মূল বিচারকগণ দেখবেন এবং তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে বেষ্ট ৮টি ব্যান্ড ও ৭ জন একক শিল্পীকে মূল পর্বে লাইভ গাওয়ার জন্য ডাকবেন।
“ক্লেয়ারভয়েন্স” এর ততোদিনে কয়েকটা গান বানানো হয়ে গেছে। সেখান থেকে “রাতের আঁধার” এবং “ঠিকানা নেই আমার” গান দুটি প্র্যাকটিস প্যাডের ক্যাসেট প্লেয়ারে রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেয়া হয় বেনসন এন্ড হেজেসের ঠিকানায়।
দিন যায়, ব্যান্ডের প্র্যাকটিস চলে, কখনো ষ্টেডিয়াম কখনো রাজেন্দ্র কলেজের মাঠ, রেললাইন, কবি জসিমউদ্দীন হলের সামনে চায়ের দোকান আড্ডায় মুখর হয়ে থাকে। এরমধ্যেই লিমনের বাসার টেলিফোনে একটা কল সবার ব্যস্ততা আরো বাড়িয়ে দেয়। ব্যান্ডের গান সিলেক্ট হয়েছে, আগামী মাসে খুলনায় লাইভ অডিশন।
খুলনা শহর। লাইভ অডিশন শেষ। ক্লেয়ার ভয়েন্সের সাথে পারফর্ম করে ফরিদপুরের আরেক সলো আর্টিস্ট শেখ আব্দুল হাদি।
পারফর্ম শেষে এককোনে বসে আছে লিমন ও সহযোদ্ধারা। ঠিক তখন একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক তাদের দিকে এগিয়ে আসে। ব্যান্ডের সাথে চলে দীর্ঘ কথা। কে কি বাজায়, কি ধরণের গান শোনা হয়, ভবিষ্যত পরিকল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
সাংবাদিক চলে যায়। ক্লেয়ারভয়েন্স ফিরে আসে।
ষ্টার সার্চ-২০০২, খুলনা অডিশনে ক্লেয়ারভয়েন্স।
পর্ব-৬
তবে কি ফরিদপুরে আর কোন ব্যান্ড ছিলনা?
৯০ দশকে ফরিদপুরে বেশ কিছু ব্যান্ড ও সাংষ্কৃতিক সংগঠন ছিল।
ইনডেক্স, রজনীগন্ধা, ব্লু স্কাই, হলিডে, অনির্বাণ শিল্পগোষ্ঠী, বহুরূপী সহ আরো কিছু ব্যান্ড। তথ্য মতে খায়রুল ও মনি ভাইয়ের “ইনডেক্স” ফরিদপুরের প্রথম ব্যান্ড। ব্লু স্কাই ব্যান্ডটি ভেঙ্গে “ক্লেয়ারভয়েন্স” ব্যান্ড গঠিত হয়েছিল।
ক্লেয়ারভয়েন্স ছাড়া বাকি ব্যান্ডগুলো রক বা হার্ডরক ঘরনার মিউজিক করতো না। অনির্বাণ ও বহুরুপী নাটক, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লোকজ সহ আধুনিক ধারার গান পরিবেশনা করতো। তাই এই দুটি সংগঠনকে ব্যান্ড বলা যেতে পারে না। এছাড়া বাকি ব্যান্ডগুলোও পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যান্ড ধারায় যুক্ত ছিল না। সফট রক, ফোক, আধুনিক সহ একক শিল্পীদের গান কাভার করতেন তারা। মূলতঃ ক্লেয়ারভয়েন্স একমাত্র ব্যান্ড যারা রক, হার্ডরক ধারার ব্যান্ড মিউজিক করতো এবং তাদের নিজস্ব গান ছিল।
পর্ব-৭
সবকিছু ভেঙে পড়ে
ষ্টার সার্চ থেকে ফিরে আসার কয়েকমাস পর আলামিন ব্যান্ড ছেড়ে ঢাকা চলে আসে। ড্রামার হিসেবে যোগ দেয় “জুবায়ের”। এর কিছুদিন পর এলিন ও সৈকত ব্যান্ড ছাড়ে নিজস্ব কারণে। চাকরি ও গান নিয়ে এগুনোর তাগিদে কিবোর্ডিষ্ট সাগর পাড়ি জমায় ঢাকাতে। কিছুদিন কাজ করার পর পড়াশোনার জন্যে জুবায়েরও ব্যান্ড থেকে বিরতি নেয়। ক্লেয়ারভয়েন্সে তখন লিমন আর পলাশ। মাঝে আরো কয়েকজন যুক্ত হলেও বেশীদিন কাজ করেনি।
একজনের সাথে আরেজন মানুষের একটা সংযোগ সেতু থাকে। এই সেতু সম্পর্কের, পরিচয়ের, ভালোবাসার। সুক্ষ সুঁতোর মতো এইসব সেতু ছিঁড়ে যায় পলকা বাতাসে। আবার সম্পর্কের সততা সেতুকে করে তোলে দারুণ মজবুত। ছিঁড়ে যাওয়া সেতু গিট বেঁধে জোড়া লাগে কখনও কখনও। সেইসব সম্পর্কের সেতু বা ব্রীজ ভেঙে যায়, ভেঙে যাওয়াই নিয়তি।
ক্লেয়ারভয়েন্সের প্রথমদিকের লাইন-আপ: বাঁ থেকে পলাশ, জুবায়ের, এলিন, সাগড়, লিমন ও সৈকত।
পর্ব-৮
জেগে ওঠার গান
২০০৩ সালে গিটারিষ্ট হিসেবে ক্লেয়ারভয়েন্সে যোগ দেই আমি। “হেজ স্প্যারো” স্কুলে লিমন ভাইয়ের ছাত্র। ড্রামসে সম্রাট, কিবোর্ডে বাবু।
নতুন লাইন-আপ নিয়ে ক্লেয়ারভয়েন্স তথা লিমন ভাই এগিয়ে চলে দূর্বার গতিতে। লিমন ভাইয়ের সাথে সার্বক্ষণিক ছায়ার মতন লেগে থাকি আমি। কবি জসীমউদ্দিন হলের অডিটরিয়ামে ক্লেয়ারভয়েন্স স্পন্সর নিয়ে নতুন লাইন-আপের প্রথম একক “উইন্টার কন্সার্ট” আয়োজন করে। ফরিদপুর শহরে স্পন্সর নিয়ে রক কনসার্ট ক্লেয়ারভয়েন্সই প্রথম করেছিল। উইন্টার কনসার্টে হলের সব টিকিট মূহুর্তেই শেষ হয়ে যায়। হাউজফুল বললে ভুল হবে, বরং হল ছেড়ে বাইরে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। কনসার্টের মাঝামাঝি সময়ে হলের গেট খুলে দিয়ে সবাইকে গান শোনার জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। ফরিদপুরের ইন্ডোর কনসার্ট ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম কনসার্ট যার সব টিকেট বিক্রি হয়েছে, ২ ঘন্টার কনসার্ট ৩ ঘন্টায় গড়িয়েছে।
ক্লেয়ারভয়েন্সের উইন্টার কনসার্টের নতুন লাইন-আপ: বাঁ থেকে লিমন, পলাশ, তানিন, বাবু ও সম্রাট।
“উইন্টার কনসার্ট” এর পর ড্রামার পরিবর্তন হয়। জুবায়ের ভাই ড্রামার হিসেবে আবার যোগ দেন। শহর থেকে গ্রাম ক্লেয়ারভয়েন্স কনসার্ট করে বেড়ায়।
উইন্টার কনসার্টের দর্শকদের একাংশ।
পর্ব-৯
ইকারুসের ডানা
২০০৪ সাল, আবার ফিরে আসে বেনসন এন্ড হেজেস ষ্টার সার্চ। খুলনা জোনে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এবার আমরা “রাতের আঁধার” আর আমার লেখা লিমন ভাইয়ের সুরে “বাংলাদেশ” গান সিলেক্ট করে রেকর্ডের জন্যে ঢাকা আসি। লিমন ভাই “সাউন্ড গার্ডেন” ষ্টুডিওতে দুই শিফট বুকিং দেন। আমরা ঢাকায় এসে উঠি খসরু আংকেলের ছেলে রক্তিম ভাইয়ের বাসায়। আমরা পাঁচ জন রক্তিম ভাইয়ের বাসায় টানা তিন দিন থাকি। ঢাকার “ষ্ট্রাইকিং” ব্যান্ডের ভোকাল মনির ও গিটারিষ্ট জামান ভাই ছিলেন রক্তিম ভাইয়ের বন্ধু। সারা রাত আড্ডা চলে, সকালে উঠে রেকর্ডিং। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার মহান “দূরে” ভাই। জামান ভাইয়ের সুবাদে আমরা রেকর্ডিং এর আগে একটা প্র্যাকটিস প্যাডে যাই যা ঢাকার প্রথম প্রফেশনাল প্র্যাকটিস প্যাডের অভিজ্ঞতা। জামান ভাই এর জন্য আমাদের রেকর্ডিং শিফটের সময়ও কিছুটা বাড়ে। দূরে ভাই এর সহযোগীতার কথা বলে বোঝানো যাবে না। মফস্বল থেকে ঢাকায় রেকর্ডিং এ এসেছি কারণ বেনসন এন্ড হেজেস ষ্টার সার্চে পার্টিসিপেট করবো। আমাদের সাহস, একাগ্রতা দূরে ভাইকে মুগ্ধ করে। লিমন ভাইয়ের গিটার বাজানোর প্রশংসা করেন স্বয়ং দূরে ভাই। রেকর্ডিং শেষে ডেমো নিয়ে বের হবার সময় দূরে ভাই বলেছিলেন “তোমাদের গান অবশ্যই সিলেক্ট হবে। পারফর্মেন্স দিয়া খুলনা উড়ায় দিবা”। আর সেই রেকর্ডিং সেশনেই মারজুক রাসেল ভাইয়ের সাথে দেখা, আড্ডা। আমরা পেয়ে যাই ইকারুসের ডানা।
সাউন্ড গার্ডেন স্টুডিওতে রেকর্ডিং সেশন ও আড্ডা। ছবিতে ক্লেয়ারভয়েন্সের সদস্য, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার দূরে, মোস্তাফিজ বিপ্লব, রক্তিম, সবুজ ও বন্ধুরা
পর্ব-১০
বেনসন এন্ড হেজেস ষ্টার সার্চ-২০০৪
বেনসন এন্ড হেজেসের ঠিকানায় ডেমো গান জমা দেয়ার মাস খানেক পড়ে লিমন ভাইয়ের নম্বরে ফোন আসে যে আমরা সিলেক্টেড। এর মধ্যে পলাশ ভাই চাকরীর সন্ধানে ঢাকা পাড়ি জমায়। আমাদের সাথে যুক্ত হয় বেস গিটারিষ্ট বিপ্লব ভাই। খুলনা রেস্ট হাউজে লাইভ অডিশনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দেই। দিন রাত এক করে প্র্যাকটিস।
অবশেষে খুলনা। রেস্ট হাউজের প্রাঙ্গন মিউজিশিয়ানে ভরে আছে। নাবালক আমি ভীরু চোখে দেখি এইসব। লিমন ভাই ভরসা দেয়। অডিশনের ওপেনিং পারফরমেন্স আমাদের। সাউন্ড চেক দেই। সাউন্ড চেক দেয়ার সময়েই বিচারকের আসনে শ্রদ্ধেয় পার্থ বড়ুয়া আর শাকিলা জাফরকে দেখতে পাই। তারপর মূল অডিশন দিয়ে যখন আমরা হল থেকে বেড় হই তখনও বুঝতে পারিনাই কি হয়েছে। চারদিক থেকে খুলনার মিউজিশিয়ানরা ঘিরে ধরে। আমাদের পারফর্মেন্সে তারা অবাক। গর্বের সাথে বলছি তারা অবাক। সেখানকার মিউজিশিয়ানরা লিমন ভাইয়ের অটোগ্রাফ নেয়ার জন্যে পিছনে ছুটেছে, খুলনার প্র্যাকটিস প্যাডে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে।
ষ্টার সার্চ-২০০৪, খুলনা অডিশন
খুলনা থেকে ফিরে আসার মাস দুই পরে বেনসন হেজেসের ফোন আসে। আমরা সিলেক্টেড। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ৮টি ব্যান্ড এবং ৮ জন একক শিল্পী মিলে সে বছর বেষ্ট-১৬ অনুষ্ঠিত হয় শেরাটন হোটেলের উইন্টার গার্ডেন হলে। আমরা বলতেই পারি বাংলাদেশের ৮টি ব্যান্ডের মধ্যে আমরা ছিলাম। জয়ী হতে পারিনাই, জয়ী হবার জন্যে আমরা অংশগ্রহণও করি নাই। অংশ নিয়েছিলাম আমাদের যাচাই করার জন্যে।
ষ্টার সার্চ-২০০৪, ফাইনাল। হোটেল শেরাটনের উইন্টার গার্ডেন হল।
তখন ফেসবুক নাই, ইউটিউব নাই, বাংলাদেশে ইন্টারনেট সহজলভ্য না। ছিলনা টেলিভিশনের ক্লোজআপ ওয়ান, ডি-রকষ্টার বা এ জাতীয় কোন অনুষ্ঠান। পত্রিকা কাভারেজ আমরা পেলেও তা যথেষ্ট ছিল না। আজকের মতন এইরকম পরিবেশ থাকলে আমরাও হয়তো “হিট” খেতাব প্রাপ্ত কেউ হতাম অথবা না। অন্তত ইউটিউবে আমাদেরকে খুঁজে পাওয়া যেত।
পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু খবর।
পর্ব-১১
হ্যালো ঢাকা!
২০০৪ এর শেষে লিমন ভাই ঢাকায় চলে আসেন। আমি আর কিবোর্ডিষ্ট বাবুও পড়াশোনার সুবাদে ঢাকায়। লিমন ভাই তখন একটা ফার্মে চাকরি করেন। থাকেন মিরপুরের রূপনগড় এলাকায়। আর আমি শ্যাওড়াপাড়া। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আমাদের আড্ডা হয়। লিমন ভাই অফিস থেকে মিউজিকের নানাবিধ বিষয় প্রিন্ট করে আনে আর আমি সেগুলো ফটোকপি করে নিয়ে যাই। ধানমন্ডি এলাকার একটা ব্যান্ডের গানে লিমন ভাই গিটার বাজিয়ে দেয়। তার গিটারের জাদুতে সেই ব্যান্ড তাদের সাথে বাজানোর নিমন্ত্রণ জানান। কিন্তু লিমন ভাইয়ের মন ক্লেয়ারভয়েন্সের কাছে পড়ে আছে।
লিমন ভাই আর আমি দুজন মিলে ঢাকায় ক্লেয়ারভয়েন্সের যাত্রা শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। বেস গিটারে মহিউদ্দিন বাবু, ড্রামসে পাভেল। শুরু হয় ঢাকা যাত্রা। মগবাজার, ফার্মগেট, হাতিরপুল, মিরপুর এলাকার প্র্যাকটিস প্যাডে আমরা নিয়মিত। “ব্যান্ড মেলা” নামে একটি মিক্সড এ্যালবামে “রাতের আঁধার” গানটাও রিলিজ হয়েছে। পরিচিত অপরিচিত মানুষের বাহবা পাচ্ছি।
লিমন ভাই মিরপুর-১০ নম্বরে বাসা নেয়। তার বাসা, চায়ের দোকান, শাহ আলী প্লাজার পাশের রেষ্টুরেন্ট আমাদের আড্ডাস্থল। নিজেদের গান নিয়ে গবেষণা।
মিক্সড ব্যান্ড এ্যালবাম “ব্যান্ড মেলা” এ প্রকাশিত ক্লেয়ারভয়েন্সের গান “রাতের আঁধার”।
পর্ব-১২
বারবার ফিরে আসি কুমার নদের তীরে
ঢাকা লিমন ভাইকে বেঁধে রাখতে পারেনি। ফরিদপুরে তিনি ফিরে আসেন। একা, একেলা। আমি পড়াশোনার জন্যে ঢাকা ছাড়তে পারিনাই। লিমন ভাইয়ের সাথে ছায়ার মত লেগে থাকা আমি গোলকধাঁধায় পড়ে থাকি।
ফরিদপুর ফিরে এসে লিমন ভাই দমে জাননি। মুদাব্বির, মুবদিউ-কে নিয়ে শুরু করেন তার স্বপ্নের ক্লেয়ারভয়েন্স। কোর্ট চত্বরে মুদাব্বিরের দোকানে দিন শেষে প্র্যাকটিস চলে। পরবর্তীতে ঈশান স্কুলের একটি রুমে প্র্যাকটিস প্যাড করা হয়।
মুদাব্বির ও মুবদিউ ব্যান্ড ছেড়ে নতুন ব্যান্ড গঠন করে। ক্লেয়ারভয়েন্সের লাইন-আপে পরিবর্তন আসে। গীতিকার ও গিটারিষ্ট মোস্তাফিজ বিপ্লব ভাই যোগ দেন, উজ্জ্বল এবং আরো অনেকে। ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন হয়ে “ব্যালেন্স” হয় এবং কিছুকাল পরে আবার ক্লেয়ারভয়েন্স নামে ফিরে আসে। সময়ের প্রয়োজনে ব্যান্ডের সদস্যরা চলে যায়। থাকে শুধু লিমন ভাই আর ক্লেয়ারভয়েন্স।
পর্ব-১৩
একজন সহযাত্রী
লিমন ভাই এবং ক্লেয়ারভয়েন্স অসম্পূর্ণ তিনি ছাড়া। হাসি ভাবি। লিমন ভাইয়ের সহধর্মিনী।
ভালোবেসে বিয়ে করে লিমন ভাই ও ভাবী লক্ষীপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন (যেখানে “ক্লেয়ারভয়েন্স” এর জন্ম)। লিমন ভাইয়ের গিটার স্কুল “হেজ স্প্যারো” এর সবাই সেই দুই কামড়ার বাসায় যখন তখন যাই। হাসি ভাবী আমাদের আদর করে বসায়। চা খাওয়ায়। দুপুরের খাবার, সন্ধ্যার নাস্তা সব। মনযোগ দিয়ে আমাদের বাজনা শোনেন। উৎসাহ দেন। পড়াশোনার খোঁজ নেন। ভাবী আমাদের বড় বোনের মতন যত্ন করে রাখেন।
কবি জসিমউদ্দীন হলের অডিটরিয়ামে “উইন্টার কনসার্ট”, “কনসার্ট ফর রানা”, “বন্যার্তদের সহযোগীতা”, “রক উইথ ক্লেয়ারভয়েন্স” সহ প্রায় ১০টি কনসার্ট আমরা করেছি। সবগুলো টিকিট শো এবং হাউজ ফুল। হাসি ভাবী প্রতিটি কনসার্টে চা, গরম পানি, স্ন্যাকস নিয়ে যেতেন। বলে রাখা ভালো যে, আমরা কোনদিন তাকে এইসব নিয়ে যেতে বলি নাই। তিনি নিজ দায়িত্বে এসব করতেন। এমনকি এসবের জন্য যে খরচ হতো তাও তিনি তার জমানো টাকা থেকে করতেন। কোনদিনিই টাকা চান নি। শো’র মধ্য বিরতিতে তিনি হয়ে উঠতেন আমাদের ভরসা। গ্রীণ রুমে এসে আমাদের ঘাম মুছিয়ে দিয়ে জোড় করে খাইয়ে দিতেন। শুধু ফরিদপুর না, লিমন ভাই এবং ক্লেয়ারভয়েন্সের ঢাকা শহরের জীবনেও তিনি ছিলেন অভিন্ন।
লিমন ভাইয়ের গিটার বাজানো, গান লেখা, সুর ও কম্পোজিশনে হাসি ভাবীর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। মনে প্রাণে তিনি চাইতেন লিমন ভাই যেন মিউজিক নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাক।
২০১৬/১৭ সালের দিকে ঢাকা থেকে ফরিদপুরে গিয়ে দেখা ক্লেয়ারভয়েন্সের কনসার্টেও সেই এক এবং অভিন্ন হাসি ভাবীকে দেখেছি।
হাসি ভাবী। একজন সহযাত্রী।
পর্ব-১৪
লিমন ভাই, আমি ও আমরা
লিমন ভাইয়ের কাছে গিটার শেখার আগে আমি পলাশ ভাইয়ের কাছে যাই। ব্যাপ্টিস্ট চার্চ মিশন স্কুলের ভিতরে পলাশ ভাইয়ের বাসায় একদিন এবং একমাত্র ক্লাসে আমি “এ মাইনর” কর্ড শিখি। আর শুনি তার গলায় অঞ্জন দত্তের গান “তুমি না থাকলে”। পলাশ ভাই আমাকে লিমন ভাইয়ের কাছে নিয়ে আসে। ফরিদপুর ষ্টেডিয়ামের গ্যালারিতে আমার প্রথম গিটার ক্লাস। বিশাল গ্যালারি সম্পূর্ণ ফাঁকা। লিমন ভাই গিটার বাজাচ্ছে। প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে সুর। প্রথম ক্লাসের সেই মোহময় পরিবেশ এখনও আমাকে ভাবায়।
আমি গান লিখতাম, সুর করার চেষ্টা করতাম। লিমন ভাই আমাকে উৎসাহ দিত এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। লিমন ভাই শুধু আমার প্রথম গিটার শিক্ষক নন। তিনি আমার ভাই, তিনি বটবৃক্ষ যার ছায়ায় আমি এবং আমার মত অনেকের মিউজিকের স্বপ্ন বেড়ে উঠেছে একটু একটু করে। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
আমার লেখা আর লিমন ভাইয়ের সুর করা প্রায় ৪/৫টি গান, লিমন ভাই ও আমার যৌথভাবে লেখা এবং লিমন ভাইয়ের সুরে দুইটি গান, আমার লেখা সুরে একটি গান সহ আগের ২/১টি গান তখন প্র্যাকটিসে বা কনসার্টে নিয়মিত গাওয়া হচ্ছে। রথখোলায় অবস্থিত “অনির্বাণ শিল্প গোষ্টী” এর কার্যালয়ে প্রতি শুক্রবার বা যখন প্রয়োজন আমরা প্র্যাকটিস করি। অনির্বাণের ইন্ডিয়ান বাপ্পী ড্রামস (প্রায় মৃত), বয়সের ভারে নুয্য যশোর থেকে বানিয়ে আনা ৫টি ইনপুটের এ্যাম্প, নিজেদের ভাঙাচোড়া গিটার, খেলনা কিবোর্ড আর চায়না মাইক্রোফোন এই সম্বল। পুরোন ভাঙা বাড়িটাতে কোন বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলনা। বাড়িটার একটি ঘরে রিক্সাচলক দম্পতি বাস করতেন। তারা কিভাবে যেন আমাদের বিদ্যুতের লাইন ম্যানেজ করে দিতেন। অনির্বাণের তৎকালীণ কর্ণধার কল্লোল ভাই এবং ভাবী আমাদের প্রচন্ড আদর করতেন, ভালোবাসতেন। মাগরিব নামাজের বিরতির পর আবার প্র্যাকটিস শুরু হতো, এলাকার শিশু থেকে বয়স্করা আড়ালে দাঁড়িয়ে গান শুনতো। এইসব সহযোগীতা ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়া আর কিই বা আছে।
পর্ব-১৫
ভেবে দেখেছ কি?
অতীত এবং বর্তমানের ফারাক বিস্তর। ১৯৯৪/৯৫ সালে ফেসবুক, ইউটিউব, সিডি, ডিভিডি, ইন্সট্রাকশন ভিডিও, গিটার বুক ছিলনা। ঢাকা শহরে গিয়ে গিটার শিখতে যাওয়াটা ছিল রীতিমত অসম্ভব। একমাত্র সম্বল ছিল ফিতা ক্যাসেট, ভুলে ভরা কিছু বাংলা বই। সেই অসম্ভব সময়ে লিমন ভাই ও তার সহযোদ্ধারা ফরিদপুরের মতন মফস্বল শহরে রক বা হার্ডরক মিউজিকের রেভ্যুলেশন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে ফরিদপুরকে নিয়ে গিয়েছিলেন সমগ্র বাংলাদেশের সেরা ৮টি ব্যান্ডের ব্যাটেলের আসরে। তৎকালীন সময়ে অনেকে লিমন ভাইকে দেখে গিটার বাজাতে উৎসাহী হয়েছিলেন। ব্যান্ড গঠন করার সাহস করেছিলেন।
আজকে ইন্টারনেটে, ইউটিউবে “How to play…..” সার্চ দিলেই আপনারা সব কিছু হাতের মুঠোয় পেয়ে যান। প্রায় সব গানের টেবুলেচার, মোবাইলে কতশত এ্যাপ্স। অথচ আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে সময়টা এরকম ছিল কি?। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ফিতা ক্যাসেট থেকে গান তোলা, গিটারের সলো তোলা, বেস গিটার, কিবোর্ড, ড্রামস কি বেজেছে তা জানার জন্যে দিনরাত এক করেছেন লিমন ভাই। ১৫/২০ বছর আগে এই শহরে ভালো সাউন্ড কোম্পানি ছিলনা। যশোর বা খুলনা থেকে সাউন্ড ভাড়া আনতে হতো যা ঢাকার তুলনায় নগন্য। সেই নগন্য সাউন্ড দিয়ে ফরিদপুরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কনসার্ট করেছেন তিনি ও তার ব্যান্ড। এখন তো ফেসবুকে বাংলাদেশের প্রায় সকল জনপ্রিয় ও উঁচু মাপের সংগীত শিল্পীদের সহজেই পাওয়া যায়। চাইলেই ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠানো যায়, দেখা করাও যায়। কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে কখনোই তা সম্ভব ছিলনা। আর এই অসম্ভাব্য সময়ের গিটার বাদক চৌধুরী আবুল কালাম লিমন।
চৌধুরী আবুল কালাম লিমন। ফরিদপুরের রক/হার্ডরক মিউজিকের পথিকৃত, গিটারিষ্ট ও ভোকাল।
পর্ব-১৬
কত কি করার আছে বাকি
ফরিদপুরে রক বা হার্ডরক ধারার ব্যান্ডের অপূর্ণতা সবসময়ই ছিল এখনও আছে। কিন্তু এই না থাকাটা পূরণ করা অত্যন্ত জরুরী।
ক্লেয়ারভয়েন্স এর পরপরই কিছু ব্যান্ড গঠন হয়েছিল। তবে সবাই সক্রিয় থাকতে পারেনি। কয়েকমাস/বছর পর ব্যান্ড ভেঙ্গে যায়। তবে দীর্ঘদিন সক্রিয় ব্যান্ডের মধ্যে ভোকাল ও গিটারিষ্ট বাবু, ড্রামার সম্রাট, বেজিষ্ট বাদল (প্রয়াত) এর হাতে গড়া “রেইন ড্রপ” অন্যতম। তারাও ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে কনসার্ট করেছিল। তথ্য মতে রেইন ড্রপে পরবর্তীতে গিটারিষ্ট হিসেবে যোগ দেয় জীবন এবং তারও পরে রকি। অনেক পরে এসে রকি, জুনেট, শহীদ, অপু আর হাসান মিলে গঠন করেছিলেন “আর্সা” নামে একটি ব্যান্ড। দীর্ঘদিন কাজ করে বর্তমানে তারা নিস্ক্রিয় রয়েছে।
ফরিদপুরে বর্তমানে একমাত্র সক্রিয় ব্যান্ড “অংশ”। ফরিদপুর ও আশেপাশে কসার্ট করছে তারা। মুবদিউ, মুদাব্বির, সুদিপ্ত, তন্ময় আর বাঁধন অংশের অংশ। নিজেদের গান নিয়েও কাজ করছে “অংশ”।
এছাড়াও ল্যাম্পপোষ্ট সহ আরো কিছু ব্যান্ড ছিল যারা এখন আর সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না। তবে আশার কথা ২০২০ সালের শুরুতে কয়েকটি ব্যান্ড গঠন হয়েছে যার মধ্যে “ব্রোকেন”, “পার্পেল ব্লুজ” অন্যতম।
হয়তো আরো অনেক ব্যান্ড রয়েছে যা আমার অজানা অথবা তথ্য সংগ্রহে ঘাটতি রয়েছে। যারা সক্রিয় অথচ নাম উল্লেখ করতে পারি নাই তারা নিজ গুনে ক্ষমা করবেন।
পর্ব-১৭
শেষ বলে কিছু নেই
লিমন ভাইয়ের হাত ধরে ফরিদপুরের রক/হার্ডরক ব্যান্ড সংগীত মুভমেন্ট ও তার সাথে জড়িত সকল সিনিয়র মিউজিশিয়ান স্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে পারেন না।
দীর্ঘ লেখাটা হয়তো লিমন ভাই এবং ফরিদপুরের ব্যান্ড মিউজিকের ইতিহাস হিসেবে প্রথম। তবে আরো অনেকে আসবে, লিখবে, গবেষণা করবে, সমৃদ্ধ হবে ফরিদপুরের সংষ্কৃতি।
২৫ বছর আগের ফরিদপুর এখন আর নেই। দেশের অন্যতম আধুনিক শহর এটি। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। অতীতকে সম্মান দিয়ে নতুনরা এগিয়ে যাবে বহুদূর।
তথ্য প্রদান করে সহযোগীতার জন্য সশ্রদ্ধ নিবেদন:
লিমন ভাই, তার সংগীত, ফরিদপুরের ব্যান্ড মিউজিক সম্পর্কে অতীতের তথ্যাদি দিয়ে সহযোগীতার জন্য পলাশ ভাই, মোস্তাফিজ বিপ্লব ভাই এবং ফরিদপুরের বর্তমান ব্যান্ড মিউজিকের অবস্থা ও সক্রিয় ব্যান্ডের তথ্য সরবরাহের জন্য মুদাব্বির, মুবদিউ, সুদীপ্ত ও তন্ময়-কে ধন্যবাদ। এই লেখাটির জন্য অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দেয়ার জন্য ফরিদপুরের অন্যতম ফটোগ্রাফার, নাট্য নির্মাতা, সংগঠক এবং আমার অত্যন্ত কাছের ছোট ভাই এমাদুল হাসান-কে জানাই ভালোবাসা।
ফরিদপুরের রক মিউজক এগিয়ে যাক বহুদূর…
জয় রক \\m//
খোলা চিঠি
প্রিয় লিমন ভাই,
প্রযত্নে, তানিন
মনে পড়ে? সেই লক্ষীপুরের ভাড়া বাসা, ঘুমঘুম দুপুরে কয়েকজন কিশোর গিটার বাদক, ক্যাসেট প্লেয়ার, আনকোরা নতুন গানে সুর মেখে রাঙিয়ে তোলা সেইসব দিন? গিটার, গান, ক্লেয়ারভয়েন্স আপনার সমস্ত সত্তা জুড়ে। মাঝে মাঝে এসব ভেবে নষ্টালজিক হয়ে যাই, কান্না পায় খুব, কেমন যেন হাহাকার জেগে ওঠে, এই জীবন অর্থহীন মনে হয়, মনে হয় সব ছেড়ে ছুঁড়ে ফিরে যাই। কিন্তু নিদারুণ বাস্তব বেহায়ার মতন পথ রোধ করে, বাঁধা দেয়।
আচ্ছা, আপনার কালো গিটারটার খবর কি? উন্টার কনসার্ট, বেনসন এন্ড হেজেস ষ্টার সার্চ-২০০৪, ঢাকার ব্যান্ড জীবনে গিটারটা কি দারুণ সঙ্গ দিয়েছে তাই না! লাল রঙের কর্গের গিটার প্রসেসর যেটা থেকে মেটাল টোন বের করার জন্যে আমরা দিনের পর দিন চেষ্টা করতাম। কেমন আছে তারা?
জানেন? ফরিদপুর বা ঢাকায় আপনি আমাকে ছাড়া অন্যকোন মিউজিশিয়ানের সাথে একা আড্ডা দিলে খুব খারাপ লাগতো, আমার সহ্য হতো না। যেদিন আপনি ঢাকা থেকে স্থায়ীভাবে ফরিদপুরে চলে গেলেন সেদিন আমার দম বন্ধ লাগছিল। এই শহর এতো ফাঁকা আর কখনোই লাগেনি।
কিছুদিন আগে অফিসের কাজে গিয়েছিলাম ঢাকার কেরাণীগঞ্জে। অনেক পুরোন একটা বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়াই। রথখোলার সেই ভাঙা বাড়িটা, দেয়াল বেয়ে উঠে গেছে বট গাছ, সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্লেয়ারভয়েন্সের অতীত মানুষগুলো। আমার পা চলে না। আমি কি ডে-জা-ভ্যু এর চক্করে পরে গেছি!
যে কথাগুলো আপনাকে কখনই বলা হয় নাই আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে। অথচ কথা খুঁজে পাচ্ছি না। এমন হয় কেন? কথাগুলা খেই হারিয়ে ফেলে, ভাবনারা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে, কেন?
আপনি যা করেছেন তার প্রতিদান কেউ দিতে পারবে না কোনদিন। ফরিদপুরের ব্যান্ড মিউজিক তথা সামগ্রিক সংগীতে আপনার ত্যাগ, শ্রম ও অবদানের জন্য সকলের পক্ষ থেকে জানাই অভিবাদন, সালাম।
লিমন ভাই। আপনাকে ভালোবাসি।
ইতি,
তানিন
প্রতিবেদনটি লিখেছেন তানিন
NICE