আমার দেখা চকবাজার পর্ব ২
11/05/2024
Page Visited: 80
126 Views
আমার দেখা চকবাজার
পর্ব ২ : কবি কাজী নজরুল ইসলাম
লিখেছেন জনাব কামরুল বারি কামা।
কবি কাজী নজরুলের ইসলামের ফরিদপুর সফরের কথা সবার জানা। তবুও সংক্ষেপে বলছি। বলার আর একটি কারণ হলো একবারের সফরের কবি জসিমউদ্দিন নজরুলকে নিয়ে চক বাজারের গিয়েছিল দুপুরের খাবার খেতে। আমার বিষয়বস্থু হলো সেই ‘হোটেল’, যেখানে দুজনে লাঞ্চ সেরেছিলেম।
নজরুল অন্তত সাতবার বৃহত্তর ফরিদপুরে আসেন – পাঁচবার ফরিদপুর শহরে, একবার মাদারীপুরে এবং একবার পাংশায়। শহরের তিনবারের সফরের বর্ণানা জসিমউদ্দিনের ‘যাঁদের দেখেছি’ বইতে লেখা আছে।একবারের বর্ণনা জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনিতে লেখা আছে।
কবি নজরুল প্রথম আসেন ১৯২৫ সালে বাংলার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে, অনুষ্ঠিত হয় ফরিদপুরে। অল বেঙ্গল কংগ্রেস কনফারেন্স, অল বেঙ্গল স্টুডেন্ট কংগ্রেস কনফারেন্স এবং অল বেঙ্গল মুসলিম কংগ্রেস কনফারেন্স।
ওই সম্মেলন তিনটিতে উভয় বাংলার ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা-কর্মী ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গীয় কংগ্রেসের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ফরিদপুর টেপাকোলা মাঠে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ওই সম্মেলনে যোগ দিয়ে তার বিখ্যাত গান ও কবিতা পরিবেশন করেন। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এতে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সম্মেলনে এসে কবি নজরুল একজন বামপন্থী নেতাসহ চারজনের একটি দল পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়িতে ওঠেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের (৫.১১.১৮৭০-১৬.৬.১৯২৫) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে মহাত্মাগান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮), নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু (২৩.১.১৮৯৭-১৯.৮১৯৪৫), সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯-১৯৪৯), মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-২২.২.১৯৫৮) যোগ দিয়ে বক্তৃতা করেন।সম্মেলনটি স্থায়ী হয়েছিল তিন দিন, বাইরে থেকে আসা নেতা ও কর্মীরা তাবুতে অবস্থান করেছিল।
ভারতবর্ষের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে ইংরেজ শাষন আমলে এত বড় একটা সম্মেলন ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত হওয়া ফরিদপুরের জন্য গর্ব ও সম্মানের ব্যাপার। এই সম্মেলন এটাই প্রমান করে যে সেই সময় ফরিদপুরের ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তা, চেতনা ও কর্মকান্ড তৎকালিন ভারতবর্ষে সমাদ্রিত ছিল।
দ্বিতীয় সফর – নির্বাচনী প্রচারনা।
১৯২৬ সালে যখন ‘ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইনসভা’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখন সারা বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি।নির্বাচনে কংগ্রেস-সমর্থিত অর্থাৎ স্বরাজ পার্টির প্রার্থী ছিলেন কবি নজরুল। নির্বাচনী এলাকা (Constituency) – ঢাকা , ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশাল। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
তৃতীয় সফর – সনটা আমার জানা নেই, ১৯২৭ সন হবার সম্ভাবনা বেশী। ঐ সফরে কবি জসিম উদ্দিনের লেখার অংশবিশেষ নীচে তুলে ধরলাম ,
“একবার পরলোকগত সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে কবি আর হেমন্তকুমার সরকার আমাদের ফরিদপুরে আসিলেন। সরোজিনী নাইডু একদিন পরেই চলিয়া গেলেন। কবিকে আমরা কয়েকদিন রাখিয়া দিলাম।আমি তখন ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়ি। আমরা সকল ছাত্র মিলিয়া কবিকে কলেজে আনিয়া অভিনন্দন দিব, স্থির করিলাম। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল কামাখ্যাচরণ মিত্র মহাশয় খুশী হইয়া আমাদের প্রস্তাবে রাজি হইলেন।
খবর পাইয়া ফরিদপুরের পুলিশ-সাহেব আমাদের প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়ের নিকট পত্র লিখিলেন, নজরুলের মতিগতি গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে; তিনি তাঁহার বক্তৃতায় সরলমতি ছাত্রদিগকে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষেপাইয়া তুলিবেন। নজরুলকে যদি কলেজে বক্ততা করিতে দেওয়া হয়, তবে সি. আই. ডি. পুলিশদেরও কলেজের সভায় উপস্থিত থাকিতে দিতে হইবে। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল কামাখ্যা বাবুর প্রতিও গভর্নমেন্টের মুনজর ছিল না। বহু বৎসর আগে তিনি পুলিশের কোপদৃষ্টিতে অন্তরীণ ছিলেন। নজরুলকে দিয়া বক্ততা করাইলে পরিণামে কলেজের ক্ষতি হইতে পারে বিবেচনা করিয়া তিনি আমাদিগকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, ‘নজরুলকে লইয়া কলেজে যে সভা করার অনুমতি দিয়েছিলাম, তাহা প্রত্যাহার করলাম।’
আমরা মুষড়িয়া পড়িলাম। সবাই মুখ মলিন করিয়া কবির কাছে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদের অবস্থা দেখিয়া কবি বলিলেন, ‘কুছ পরওয়া নেই। উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে সভা কর। আমি সেইখানে বক্তৃতা দেব।’
তখন আমাদিগকে আর পায় কে! দশ-বিশটা কেরোসিনের টিন বাজাইতে বাজাইতে সমস্ত শহর ভরিয়া কবির বক্তৃতা দেওয়ার কথা প্রচার করিলাম। সন্ধ্যাবেলা অম্বিকা-হলের ময়দান লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার নর-নারী আসিয়া জমায়েত হইলেন কবি-কণ্ঠের বাণী শুনিবার জন্য।
সেই সভায় কবিকে নূতনরূপে পাইলাম। এতদিন কবি শুধু দেশাত্মবোধের কথাই বলিতেন। আজ কবি বলিলেন সাম্যবাদের বাণী। কবি যখন ‘উঠ রে চাষী জগৎবাসী, ধর কষে লাঙ্গল’ অথবা ‘আমরা শ্রমিকদল, ওরে আমরা শ্রমিকদল’ —প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সমবেত জনতা কবির ভাব-তরঙ্গের সঙ্গে উদ্বেলিত হইতেছিল। সর্বশেষে কবি তাহার বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতা আবৃত্তি করিলেন। সে কী আবৃত্তি, প্রতিটি কথা কবির কণ্ঠের অপূর্ব ভাবচ্ছটায় উদ্বেলিত হইয়া সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়ে গিয়া ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিতেছিল। মাঝে মাঝে মনে হইতেছিল, কবিকণ্ঠ হইতে যেন অগ্নি-বর্ষণ হইতেছে। সেই আগুনে যাহা কিছু ন্যায়ের বিরোধী, সমস্ত পুড়িয়া ধ্বংস হইয়া যাইবে।”(যাঁদের দেখেছি – জসিম উদ্দিন )
অম্বিকা ময়দানে কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ বহু নেতা মিটিং করে বক্তৃতা দিয়েছে। ১৯৬৯ সন পযন্ত শহরের প্রায় সব রাজনৈতিক মিটিং হতো অম্বিকা ময়দানে। অম্বিকা ময়দানে জনসভা লোকে লোকারণ্য বা কানায় কানায় ভর্তি যে না দেখেছে তাকে বর্ণনা দিয়ে বোঝানো খুব কঠিন। তবুও আমি চেষ্টা করে দেখছি, অম্বিকা হলের বারান্দার সামনে একটি ইট-সিমেন্টর তৈরি ষ্টেজ ছিল বক্তৃতা দেবার জন্য।ষ্টেজটা পরে হয়েছে, আগে বক্তারা অম্বিকা হলের বারান্দায় বসতো।ভালো জনসভায় পুরো মাট ভরে যেত ,মাঠের লোকেরা খাসের উপর বসে বক্তৃতা শুনতো, (মাঠের তিন দিকে সীমানা প্রাচীরের কাছ দিয়ে আট/ নয়টি ইট-সিমেন্টের উপর নিট ফিনিষ্ট আস্তরের(Towel finished plaster) সুন্দর পিছনে হেলান দিয়ে বসার আসন ছিল, তিনজনে আরামে বসা যেত), যারা আগে আসতো তারা এ আসলগুলো দখলে নিতো, কিছু লোক আসন ও আড়াই ফুট উঁচু মোগল স্থপতির আদলে গড়া প্রচীরের ফাঁকা যায়গায় দাড়িয়ে যেত, ঊত্তর ও পূবের রাস্তায় ভর্তিলোক দাড়িয়ে বক্তৃতা শুনতে, সব চাইতে আকর্ষনীয় ছিল চৌরঙ্গি বিল্ডিং( যা এখন নেই, মনে হলে এক ধরনের কষ্ট অনুভব করি।) -এর দুই ও তিনতলার ছুলন্ত টানা বারান্দায় দাড়িয়ে বারান্দা ভর্তি লোকের উপস্থিতি। বড় যাত্রীবাহী জাহাজ নুতন বন্দরে নোঙ্গর করার সময় যাত্রীরা ডেকের রেলিং ধরে দাডিয়ে থাকা দৃশ্যের মত।মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তা সামনে তাকিয়ে চার স্তরের শ্রোতাদের দেখা মাত্র তার বক্তৃতার মান বেড়ে যেত।
চৌরঙ্গী বিল্ডিংয়ের একটা ছবি যুক্ত করলাম, ছবিটার মান ভালো না হওয়ায় বিল্ডিংটা কত সুন্দর ছিল তা বোঝা যাচ্ছে না।শহরে তখন তিনতলার উপরে কোন বিল্ডিং ছিল না এবং তিনতলা সবচাইতে আর্কষণীয় বিল্ডিং ছিল এই চৌরঙ্গী বিল্ডিং। এই বিল্ডিং ছিল শহরের ল্যান্ডমার্ক , দুর গ্রাম থেকে কেউ শহর দেখতে এসে চৌরঙ্গী বিল্ডিং না দেখে চলে যাওয়া মানে শহর দেখা অসম্পুর্ন থেকে যাবার সামিল।’চৌরঙ্গী’ – চৌরঙ্গী বিল্ডিং ও লেক বা ঝিল বাদে বিকলাঙ্গ। চৌরঙ্গী বিল্ডিংয়ের জায়গায় একটি যাচ্ছেতাই বাজে বিল্ডিং তোলা হয়েছে। আমার ক্ষমতা ও টাকা থাকলে ঐ জায়গায় হারানো চৌরঙ্গী বিল্ডিংয়ের মত হুবহু একটি বিল্ডিং তুলে বর্তমান স্বত্বাধিকারীকে বলতাম এটা ব্যবহার করুন কিন্ত ভেঙ্গে ফেলবেন না কারণ এর সাথে শহরের ঐতিহ্য জড়িত।
আমি আমার মূল বিষয়বস্তুতে ফিরি-নজরুলের দ্বিতীয় সফর, ১৯২৬ সন (নির্বাচনী প্রচারনা)। নজরুলের নির্বাচনী প্রচারনা সফরের বর্ণনা কবি জসিম উদ্দিনের লেখায়:
“একদিন গ্রীষ্মকালে হঠাৎ কবি আমার পদ্মাতীরের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত। তিনি কেন্দ্রীয়-আইন সভার সভ্য হইবার জন্য দাঁড়াইয়াছেন। এই উপলক্ষে ফরিদপুরে আসিয়াছেন প্রচারের জন্য। আমি হাসিয়া অস্থির : ‘কবিভাই, বলেন কি? আপনার বিরুদ্ধে এদেশে গোঁড়া মুসলিম-সমাজ কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ভোটযুদ্ধে তারাই হলেন সব চাইতে বড় সৈন্যসামন্ত। আমাদের সমাজ কিছুতেই আপনাকে সমর্থন করবে না।’
কবি তখন তার সুটকেস হইতে এক বাণ্ডিল কাগজ বাহির করিয়া আমার হাতে দিয়া বলিলেন, ‘এই দেখ, পীর বাদশা মিঞা আমাকে সমর্থন করে ফতোয়া দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের এত বড় বিখ্যাত পীর যা বলবেন, মুসলিম-সমাজ তা মাথা নিচু করে মেনে নেবে। জসীম, তুমি ভেবো না। নিশ্চয় সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বই ভাগ ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি আমি কিছু পাই, তা হলেই কেল্লা ফতে। যদি নির্বাচিত হয়ে যাই—আর নির্বাচিত আমি তো হবই, মাঝে মাঝে আমাকে দিল্লী যেতে হবে। তখন তোমরা কেউ কেউ আমার সঙ্গে যাবে।‘
রাতের অন্ধকারে আকাশে অসংখ্য তারা উঠিয়াছে। আমরা দুই কবিতে মিলিয়া তাদেরই সঙ্গে বুঝি প্রতিযোগিতা করিয়া মনের আকাশে অসংখ্য তারা ফুটাইয়া তুলিতেছিলাম।
কেন্দ্রীয় সভার ভোট-গ্রহণের আর মাত্র দুইদিন বাকী। ভোর হইলেই আমরা দুইজনে উঠিয়া ফরিদপুর শহরে মৌলভী তমিজউদ্দিন খানের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তমিজউদ্দিন সাহেব আইনসভার নিম্ন-পরিষদের সভ্য পদের প্রার্থী ছিলেন। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব। আমরা লাল মিঞা সাহেবের সমর্থক ছিলাম। বাদশা মিঞা তমিজউদ্দিন সাহেবকে সমর্থন করিয়া ফতোয়া দিয়াছিলেন। সেইজন্য আমাদের বিশ্বাস ছিল, তমিজউদ্দিন সাহেবের দল নিশ্চয়ই কবিকে সর্মথন করিবেন। কারণ বাদশা মিঞাও কবিকে সমর্থন করিয়া ইতিপুর্বে ফতোয়া দিয়াছেন। আর, লাল মিঞার দলে তো আমরা আছিই। সুতরাং সবাই কবিকে সমর্থন করিবে।
কবিকে সঙ্গে লইয়া যখন তমিজউদ্দিন সাহেবের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, তমিজউদ্দিন সাহেব তাঁহার সমর্থক গুণগ্রাহীদের দ্বারা পরিবৃত হইয়া দরবার সাজাইয়া বসিয়াছিলেন। কবিকে দেখিয়া তাঁহারা সবাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কবি যখন তাঁহার ভোটঅভিযানের কথা বলিলেন, তখন তমিজউদ্দিন সাহেবের একজন সভাসদ বলিয়া উঠিলেন, ‘তুমি কাফের। তোমাকে কোন মুসলমান ভোট দিবে না।’
তমিজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আমাদের শত মতভেদ থাকিলেও তিনি বড়ই ভদ্রলোক। কবিকে এরূপ কথা বলায় তিনি বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন। কবি কিন্তু একটুও চটিলেন না। তিনি হাসিয়া বলিলেন, ‘আপনারা আমাকে কাফের বলছেন, এর চাইতে কঠিন কথাও আমাকে শুনতে হয়। আমার গায়ের চামড়া এত পুরু যে আপনাদের তীক্ষ্ণ কথার বাণ তা ভেদ করতে পারে না। তবে আমি বড়ই সুখী হব, আপনারা যদি আমার রচিত দু-একটি কবিতা শোনেন।’
সবাই তখন কবিকে ঘিরিয়া বসিলেন। কবি আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। কবি যখন তাহার ‘মহরম’ কবিতাটি আবৃত্তি করিলেন, তখন যে ভদ্রলোক কবিকে কাফের বলিয়াছিলেন তারই চোখে সকলের আগে অশ্রুধারা দেখা দিল। কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন—যে কাজে আমরা আসিয়াছি, সে দিকে তাঁর দৃষ্টি নাই। আমি কবির কানে কানে বলিলাম, ‘এইবার আপনার ইলেকসনের কথা ওঁদের বলুন।’
কিন্তু কে কাহার কথা শোনে! কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। তখন আমি মরিয়া হইয়া সবাইকে শুনাইয়া বলিলাম, ‘আপনারা কবির কবিতা শুনছেন—এ অতি উত্তম কথা। কিন্তু কবি একটি বড় কাজে এখানে এসেছেন। আসন্ন ভোট-সংগ্রামে কবি আপনাদের সমর্থন আশা করেন। এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করুন।’
তমিজউদ্দিন সাহেব চালাক লোক। কবিতা আবৃত্তি করিয়া কবি তাঁহার সমর্থক ও ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে কিঞ্চিৎ প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন। তিনি যে কবিকে সমর্থন করিবেন না, এই আলোচনা তিনি তাঁহাদের সকলের সামনে করিলেন না। কবিকে তিনি আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। পাঁচ-ছয় মিনিট পরে হাসিমুখেই তাহারা দুইজনে আসরে ফিরিয়া আসিলেন। আসিয়া কবি আবার পূর্ববৎ কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। আমি ভাবিলাম, কেল্লা ফতে! কবির হাসিমুখ দেখিয়া এবং আবার আসিয়া তাহাকে কবিতা আবৃত্তি করিতে দেখিয়া ভাবিলাম, নিশ্চয়ই তমিজউদ্দিন সাহেবের দল কবিকে সমর্থন করিবে।
কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। বেলা দুইটা বাজিল। কবির সে দিকে হুঁশ নাই। কবির শ্রোতারাই এ বিষয়ে কবিকে সজাগ করিয়া দিলেন। কবি তাহার কাগজপত্র কুড়াইয়া লইয়া বিদায় হইলেন। তাদের মধ্য হইতে একটি লোকও বলিলেন না, এত বেলায় আপনি কোথায় যাইবেন, আমাদের এখান হইতে খাইয়া যান।
আমার নিজের জেলা ফরিদপুরের এই কলঙ্ক-কথা বলিতে লজ্জায় আমার মাথা নত হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু এ কথা না বলিলে, সেই যুগে আমাদের সমাজ এত বড় একজন কবিকে কি ভাবে অবহেলা করিতেন, তাহা জানা যাইবে না। অথচ এদেরই দেখিয়াছি, আলেম-সমাজের প্রতি কী গভীর শ্রদ্ধা! কত গরীব ছাত্রকে তমিজউদ্দিন সাহেব অন্নদান করিয়াছেন!
দুইটার সময় তমিজউদ্দিন সাহেবের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ভাবিলাম, এখন কোথায় যাই। আমার বাড়ি শহর হইতে দুই মাইলের পথ; হাঁটিয়া যাইতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগিবে। পৌঁছিতে তিনটা বাজিবে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া আজ আর শহরে ফিরিয়া কাজকর্ম করা যাইবে না। স্থির করিলাম, বাজারে কোন হোটলে খাওয়া সারিয়া অন্যান্য স্থানে ভোট-সংগ্রহের কাজে মনোনিবেশ করিব।
পথে আসিতে আসিতে কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তমিজউদ্দিন সাহেবের দল আমাদের সমর্থন করিবে। এবার তবে কেল্লা ফতে!’
কবি উত্তর করিলেন, ‘না রে, ওঁরা বাইরে ডেকে নিয়ে আমাকে আগেই খুলে বলে দিয়েছেন, আমাকে সমর্থন করবেন না। ওঁরা সমর্থন করবেন বরিশালের জমিদার ইসমাইল সাহেবকে।’
তখন রাগে দুঃখে কাঁদিতে ইচ্ছা হইতেছিল। রাগ করিয়াই কবিকে বলিলাম, ‘আচ্ছা কবিভাই, এই যদি আপনি জানলেন, তবে ওঁদের কবিতা শুনিয়ে সারাটা দিন নষ্ট করলেন কেন?’
কবি হাসিয়া বলিলেন, ‘ওরা শুনতে চাইলে, শুনিয়ে দিলুম।’
এ কথার কী আর উত্তর দিব? কবিকে লইয়া হোটলের সন্ধানে বাহির হইলাম। তখনকার দিনে ফরিদপুর শহরে ভাল হোটেল ছিল না। যে হোটেলে যাই, দেখি মাছি ভনভন করিতেছে। ময়লা বিছানা-বালিশ হইতে নোংরা গন্ধ বাহির হইতেছে। তারই মধ্যে অপেক্ষাকৃত একটি পরিষ্কার হোটেল বাছিয়া লইয়া কোন রকমে ভোজনপর্ব সমাধা করিলাম।”(যাঁদের দেখেছি – জসিম উদ্দিন )
আমার জিজ্ঞাসা, কোন হোটেলে খেয়েছিল ? ১৯২৬ সনতো আমি দেখিনি তবে ১৯৬০ সনের চকবাজার দেখেছি। খুব বড় ধরনের কোন পরিবর্তন হয়নি।১৯৬০ সনে শহরে হাতে গোনা অল্প কয়েকটি খাবার হোটেল ( রেষ্টুরেন্ট) ছিল।কিন্তু ১৯২৬ সনে শহরে কোন খাবার হোটেল(রেষ্টুরেন্ট) ছিল না নিশ্চিত।
[উপনিবেশিক শাষন আমলের সেই সময়ে ফরিদপুরের মত ছোট শহরে রেষ্টুরেন্টে খাওয়া বাতুলতার(Vanity)সামিল।তখন লোকেরা কাজে বের হবার আগে সকালে পেটপুরে বাসা থেকে ভাত খেয়ে যেত আর সন্ধায় খেয়ে গল্প গুঝব সেরে রাত আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পরতো। আমরাইতো সকাল দশটায় পেটপুরে খেয়ে স্কুলে চলে যেতাম চারটায় বাড়ী ফেরা মাত্রই মা,”সারাদিন কিছু খাসনাই”বলে খাবার থালা রেডি করে নিয়ে আসতো। প্রায়ই স্কুল থেকে ফিরে খেলার টানে বই রেখে দিতাম দৌড় খেলার মাঠে, মা পিছ পিছ আসতো খাবার থালা নিয়ে “ এই খেয়ে যা, খেয়ে যা “ বলে চিৎকার করতে করতে,কিন্তু নিরুপায় তখন মায়েদের বাইরে যাবার নিয়ম ছিল না।এই সুযোগটি কাজে লাগাতাম, এখন মনে হলে খারাপ লাগে মাকে কষ্ট দেয়ায়।শহরের এক শ্রেণীর খেটে খাওয়া মানুষ এক বেলার বেশী খাবার যোগাড় করতে পারতো না, কালকে কি খাবে জানা ছিল না।বহু মানুষ শুধু ভাতের ভ্যান খেয়ে দিন কাটিয়ে দিত। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাটির গামলা রেখে বলতো,”খালাম্মা /মাসীমা গামলাটা রাইখ্যা গেলাম,ভ্যানটা পরে আইসা নিয়া যাব”।হয়তো ওটা ওর বাচ্চাদের জন্য। সেই তুলনায় আমরা এখন অনেক ভালো আছি,স্বাধীনতার সুফল ও আল্লার রহমত। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে ভালো রাখে।]
জসিম উদ্দিনের হোটেলের বর্ণনায় ময়লা বিছানা – বালিশের উল্লেখ আছে। অর্থাৎ এটি একটি আবাসিক হোটেল ছিল এর কোন ভূল নেই। আবাসিক হোটেল মানে যেখানে থাকা,খাওয়া, নাওয়ার(স্নানের) বন্দবস্ত রয়েছ। হ্যা, নজরুল ও জসিমউদ্দিন ঐদিন কোন আবাসিক হোটেলেই খেয়েছিল। সেটি কোথায় অবস্থিত ছিল এবং দেখতে কেমন ছিল ? জসিমউদ্দিন আরো উল্লখ করেন অনেকগুলি হোটেল দেখে অপেক্ষাকৃত একটি ভালো হোটেলে দুপুরের ভোজন সম্পন্ন করেন। এটা বোঝা গেল যে ওখানে একসাথে একজায়গায় অনেকগুলো আবাসিক হোটেল ছিল( A cluster of hotels) – ফরিদপুরের ভাষায় ‘আবাসিক হোটেল পর্টি’।গুগল ম্যাপে এর অবস্থান দেখিয়ে একটি স্নাপসট যুক্ত করলাম। ম্যাপে আরো অন্য পর্টিও দেখানো আছে, যেগুলো নিয়ে পরবর্তী পোষ্টে লিখব। তখনকার ফরিদপুর বাজারের বিরল বৈশিষ্ট (Unique characteristic) হলো- ব্যবসার প্রকৃতি ভেদে নিজ নিজ cluster বা পার্টিতে সাজানো। স্বর্ণকার পর্টি, গুর পর্টি, দুধ পর্টি, আবাসিক হোটেল পর্টি, জুতা পর্টি,বই পর্টি,কুমোরপর্টি, ময়রা পর্টি ইত্যাদি।
এবার আসি আমার দেখা ‘আবাসিক হোটেল পর্টির’ আলোচনায়। হোটেল পর্টিতে যাবার তিনটি পথ ছিল, ১.চকবাজার জামে মসজিদের পথ, ২. নিউ মার্কেটের ২ নং গেটের উল্টোদিকের পথ, যার একপাশে দুধ ও পান বাজার আরেক পাশে গুর বাজার।৩.গুর পর্টির ভিতর দিয়ে, যে পথ আমরা বেশী ব্যবহার করতাম। এই এলাকায় আমার প্রায়ই যাওয়া পরতো মায়ের পান ও সাদা / আলাপাতা কেনার নিমিত্তে। মা সাদাপাতা দিয়ে পান খেত যা বাবার মোটেও পছন্দ ছিল না, তাই পান ও সাদা পাতা কেনার দ্বায়িত্বটা একান্তই আমার ঘারে এসে পরতো।গুগল ম্যাপে দেখানো দুধ বাজার তখন এখানে ছিল, একটি বিশাল (৫০ফুট x ২০০ ফুট) চারদিক উন্মুক্ত টিনের চালার ছাউনি, সিমেন্টে বাঁধানো মেঝে।এই ছাউনিতে ছিল দুধ, পান সুপারি ও তামাকের (সাদা/ আলা পাতা) বাজার, পানের দোকান ছাউনির বেশী অংশ জুড়ে থাকলেও এই বাজার দুধ বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল। দুধ বাজার বসতো সাধারণত সকালে ছাউনির দঙ্গিন-পশ্চিম অংশে,সকাল দশটার মধ্যে দুধ বিক্রী হয়ে যেত, বিকেলেও দুধের বাজার বসতো ছোট পরিসরে।
দুধ বাজারের ছাউনির পূর্বদিকে ছিল ‘আবাসিক হোটেলগুলো’, দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগ ছাউনির মাঝবরাবর থেকে শুরু হয়ে দঙ্গিন প্রান্ত পর্যন্ত পাচ৴ছয়টি হোটেল একসাথে লাগানো, এরপর চার/পাচ ফুটের রাস্তা বর্তমান থানা রোড থেকে শুরু পুকুর পর্যন্ত চলে গেছে।এই রাস্তার দঙ্গিনে দুই/তিনটির আরেক গুচ্ছ হোটেল।এই সারি সারি হোটেলর আমি নাম দিয়েছি ‘আবাসিক হোটেল পর্টি’, এর প্রচলিত নাম ‘দুধ বাজারের হোটেল’।হোটেলের গঠন – দুই পাশে বাঁশের চটার রেড়ার একচালা টিনের ঘর (ছাপড়া আকারের), বিশ ফূট চওড়া ত্রিশ/চল্লিশ ফুট লম্বা।দুটি কামরা, সামেনে বড় শোবার ঘর ও পিছে রান্না ঘর, মাঝে একটি থ্রিকোয়াটারের চটার পার্টিশন দিয়ে কামরা দুটি ভাগকরা।হোটেলের সামনে পিছে উন্মুক্ত, সামনের দিকে চার/পাচ ফুটের ব্যবধানে দুধ বাজার আর পিছে উন্মুক্ত পুকুর পাড়।সামনের কামরায় ১৫/১৬ ফুট চওড়া ও ৭ফুট লম্বা কাঠের চকি (অর্ডারদিয়ে বানানো) ৯/১০ জনের একসাথে শোবার উপযোগী।পাতলা তোশক তার উপর থান কাপড় জোড়া দিয়ে বানানো চাদরের বিছানা আর শোবার জন্য জনপতি একটিকরে ওয়ার বিহিন বালিশ। চকি ও পার্টিশনের মাঝে দশবারো ফুটের ফাকা জায়গা চলাফেরা ও নীচে বসে আহারাদি সারার জন্য।যতদুর মনে পরে মেঝে ছিল মাটির, নিয়মিত গবর দিয়ে লেপা মাটির মেঝে সানের মেঝে থেকে কম নয়।আমাদের সময় শহরে অনেক মাটির মেঝের টিনসেডের বাড়ি ছিল।হোটেলের গঠন থেকেই ঝোঝা যাচ্ছে এটা গরিবের ‘হিলটন’ হোটেল।এখানে কারো থাকতো?
১৯২৬ – ১৯৬০ সনের ফরিদপুর শহরের দিকে তাকাই। প্রথমে দেখি যোগাযোগ ব্যবস্থা,বাস্তবিক অর্থে শহরের সাথে সড়কপথে কোন যোগাযোগ ছিল অতি সামান্য।রেল যোগাযোগ ছিল, সীমিত আকারে এবং অনেকের সামর্থের বাইরে।সবচাইতে বড় যোগাযোগের মাধ্যম নদীপথ আর বহন হলো মানুষচালিত (manually operated) নৌকা।দুর্বল যোগাযোগ ও অর্থনীতির করণে নেহাত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে থেকে শহরে কেউ আসতো না।ব্যবসায়ীরা আসতো মালামাল বেচা কেনা করতে।মহাজন ধনী, শহরে আত্মীয় থাকলে তার ওখানে ওঠতো বা অন্য মহাজনের বাড়িতে থাকতো। তখন উচ্চবিত্তর বাড়িতে কাচারি ঘর থাকতো অতিথি আপ্যায়নের জন্য। অনেক মধ্যবিত্তের বাড়িতেও কাচারি ঘর ছিল। যাঁদের কাচারি ঘর ছিল না তাদের আত্মীয় বা চেনা কেউ বাইরে থেকে এলে নিজের বাড়িতে কষ্টকরে থাকতে দিতে হতো , এটাই ছিল রীতি।
মহাজনের ব্যবসায়ী কাজে বাজারে আসা দরিদ্র কর্মচারী, মামলায় জড়ানো বাইরে থেকে আসা লোক যার শহরে থাকার কোন স্থান নেই এ ধরনের লোকেরা এই হোটেলগুলোতে থাকতো বলে আমার ধরনা। তবে এরা এঁই হোটেলের মূল খরিদ্দার (Customer) নয়। মূল খরিদ্দার হলো বাজারের অস্থায়ী কোন কোন ক্ষেত্রে স্থায়ী গৃহহীন ছোট দোকানদার, বড় দোকানের গৃহহীন কর্মচারী,অল্প বেতনের বাইরে থেকে আসা চাকুরিজীবি, এক কথায় গৃহহীন খেটে খাওয়া মানুষের আশ্রয়স্থল। সারাদিন খেটে খুঁটে এসে রাতের খাবার খেয়ে নাক ডেকে ঘুম দিত, তেল চিটচিটে বিছানা বালিশ এদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারতো না।হোটেলের আর একটি ব্যবসা হলো অনাবাসিক খরিদ্দারকে সস্তায় খাবার পরিবেশন করা।তখন বাজারে এমনও দিনমুজুর কাজ করতো যে এই সস্তা হোটেলের খাবার কিনে খেতে পারতো না, দুপরে মুড়ি বাতাসা ও এক চা দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিত, দিন শেষে উপার্জনের টাকায় পরিবারের রাতের খাবারের জন্য বাজার করে নিয়ে যেত।
ফরিদপুর বাজারে গরিবের জন্য বিরল (Unique) পুষ্টিকর একটি স্ট্রিট ফুট (Street food) পাওয়া যেত।তবে একটি বিশেষ রাস্তা ছাড়া অন্য রাস্তায় এটা পাওয়া যেত না। রাস্তাটি হলো – ময়রা পর্টির রাস্তা, তিন/ চারটি বিক্রেতা/ দোকান বসতো রাস্তার পূর্ব দিকে উন্মুক্ত আকাশের নীচে।দোকানের সরন্জাম- একটি বহনযোগ্য মাটির চুলা, আগুন জ্বালানোর খড়ি, দেশী লাল গমের আটা, রুটি বেলার বেলুন ও পিঁড়া, রুটি সেঁকার তাওয়া (সবই গ্রহস্থালি সাইজের চেয়ে বড়) , আখের গুরের মোটা পাটালী, এক কলসি পানি ও একটি এলোমুনিয়ামের পনির গ্লাস। খাবারটি – লাল আটার মোটা ( ৬/৮ মি: মি: পুরু) গরম রুটি ( সাধারন সাইজের দ্বিগুন ) সাথে আখের গুরের মোটা পাটালী।গুরের রং ছিল দেখার মতো , সত্যই ফরিদপুরে এক সময় ভালো মানের গুর পাওয়া যেত।মজার ব্যাপার রুটি সেঁকা হতো তাওয়ার উল্টো পিঠে, তাওয়া ঊবুর অবস্থায় চুলের উপর রেখে রুটি সেঁকা হতো।এর দুটি সুবিধা ছিল, ১. রুটি আগুনের তাপ বেশী পেত যাতে পুরুরুটি তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হোত ২. খড়ি কম খরচ হতো।হাটের দিন রটি ও গুরের খাবারের বেচাকেনা ভালো হতো।হাটেরদিন একটি বৈশম্যমূলক ঘটনার অবতারনা হতো, মহাজন/ গেরস্থ হাটে আনা পন্য বিক্রী করে তার গরিব কর্মচারী / ভৃত্যকে নিয়ে ময়রা পর্টিতে আসতো, নিজে মিষ্টি খেতে ঢুকতো মিষ্টির দোকানে আর ভৃত্যকে খেতে দিত লাল আটার রুটি ও পাটালী গুর। শুনে আশ্চর্য হবেন একেকজন এক থেকে দেড় সের (এক কেজির অল্প কিছু কম ) করে মিষ্টি খেত, দাড়ি পাল্লায় মেপে দেয়া হতো সেই মিষ্টি । শোনা যায় হাটের দিনে রমরমা মিষ্টি বিক্রির কারনেই এক দুই করে মিষ্টির দোকান বাড়তে বাড়তে এই ‘ময়রা পর্টির’ সৃষ্টি।
Recent Comments